ভাব-সম্প্রসারণ : বাংলা ২য় পত্র - নবম ও দশম শ্রেণি, এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষা (৫ম পর্ব)
কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় কখনো কোনো একটি বাক্যে বা কবিতার এক বা একাধিক চরণে গভীর কোনো ভাব নিহিত থাকে। সেই ভাবকে বিস্তারিতভাবে লেখা, বিশ্লেষণ করাকে ভাব-সম্প্রসারণ বলে। যে ভাবটি কবিতার চরণে বা বাক্যে প্রচ্ছন্নভাবে থাকে, তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়। সাধারণত সমাজ বা মানবজীবনের মহৎ কোনো আদর্শ বা বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা, প্রেরণামূলক কোনো বিষয় যে পাঠে বা বাক্যে বা চরণে থাকে, তার ভাব-সম্প্রসারণ করা হয়। ভাবসম্প্রসারিত ক্ষেত্রে রূপকের আড়ালে বা প্রতীকের ভেতর দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, তাকে যুক্তি, উপমা, উদাহরণ ইত্যাদির সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে হয়।
ভাব-সম্প্রসারণ করার ক্ষেত্রে যেসব দিক বিশেষভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন :
- উদ্ধৃত অংশটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।
- অন্তর্নিহিত ভাবটি বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
- অন্তর্নিহিত ভাবটি কোনো উপমা-রূপকের আড়ালে নিহিত আছে কি না, তা চিন্তা করতে হবে।
- সহজ-সরলভাবে মূল ভাবটিকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
- মূল বক্তব্যকে প্রকাশরূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে।
- বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- বক্তব্য সাধারণত বিশ থেকে পঁচিশ লাইনের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে।
পিতামাতা গুরুজনে দেবতুল্য জানি,
যতনে মানিয়া চল তাহাদের বাণী।
মূলভাব : বাবা, মা ও অভিভাবকবৃন্দ আমাদের জীবন গঠন ও পরিচালনার জন্য যেসব উপদেশ দেন, সেগুলো মেনে চলা আমাদের একান্ত কর্তব্য।
সম্প্রসারিত ভাব : পিতা-মাতা আমাদের সবচেয়ে আপনজন। অনেক কষ্ট করে তাঁরা আমাদের লালন-পালন করেন। পিতা-মাতার সঙ্গে অন্য গুরুজনরাও আমাদের সুস্থ জীবন বিকাশে সহায়তা করেন। তাঁরা আমাদের স্নেহ করেন, ভালোবাসেন এবং সর্বদাই মঙ্গল কামনা করেন। এঁরা সবাই বয়সে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, প্রজ্ঞায় আমাদের থেকে অনেক বড়। অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁরা জানেন কী করলে আমাদের ভালো হবে। আর কোন পথটি আমাদের জন্য ক্ষতিকর। নবীনতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে এই কঠিন ও জটিল পৃথিবীর অনেক কিছুই আমাদের অজানা। সে জন্য পিতা-মাতা, গুরুজন ও বিশ্বের মহান ব্যক্তিদের উপদেশ চলার পথের আলোকবর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আর তা অবহেলা করলে জীবনে সফলতা আসবে না। প্রতি মুহূর্তেই আমরা হোঁচট খাব। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বায়েজিদ বোস্তামি গুরুজনদের আদেশ-উপদেশ শ্রদ্ধাভরে পালন করেছেন। আর সে কারণেই তাঁরা সকলের শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হতে পেরেছেন। তাই পিতা-মাতা, গুরুজন আদর্শস্থানীয়, দেবতুল্য এবং আরাধনাযোগ্য। তাঁদের বাণী অনুসরণ করে নিজের জীবন গড়তে হবে এবং দেশ, জাতি তথা সমগ্র বিশ্বকে শাশ্বত কল্যাণের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।
মন্তব্য : পিতা-মাতা, গুরুজন ও বিশ্বের মহান ব্যক্তিদের উপদেশ মানলে নিজের জীবন সুন্দর ও বিকশিত হবে এবং দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারবে।
নানান দেশের নানান ভাষা
বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা?
মূলভাব : মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ যেকোনো কিছুর প্রকৃত রস আস্বাদন করতে পারে এবং এই ভাষাতেই তার প্রাণের স্ফ‚র্তি ঘটে।
সম্প্রসারিত ভাব : পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই নিজস্ব ভাষা আছে এবং এক ভাষা থেকে অন্য ভাষা আলাদা। ভাষার মাধ্যমে আমরা শুধু নিজের মনের ভাবই অন্যের কাছে প্রকাশ করি না, মাতৃভাষার সাহায্যে অন্যের মনের কথা, সাহিত্য-শিল্পের বক্তব্যও নিজের মধ্যে অনুভব করি। নিজের ভাষার কিছু বোঝা যত সহজ, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। বিদেশে গেলে নিজের ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায় আরও প্রবলভাবে। তখন নিজের ভাষাভাষী মানুষের সান্নিধ্য পেতে ভেতরে ভেতরে মরুভ‚মির মতো তৃষিত হয়ে থাকে মানুষ। আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, পড়ালেখা করি, গান গাই, ছবি আঁকি, সাহিত্য রচনা করি, হাসি-খেলি, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করি। অন্য ভাষায় আমাদের সব অনুভ‚তি স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের শুরুতে অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করে পরে আক্ষেপ করেছেন এবং মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছেন। মায়ের মুখের বুলি থেকে শিশু তার নিজের ভাষা আয়ত্ত করা শুরু করে এবং এই ভাষাতেই তার স্বপ্নগুলোকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে, এই ভাষাতেই লেখাপড়া করে এবং জগৎ ও জীবনকে চিনতে শুরু করে। ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রক্ষার জন্য, দেশ-বিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত রাখার জন্য আমাদের অন্যান্য ভাষাও শিখতে হয়। কিন্তু কোনো বিষয় বোঝার জন্য মাতৃভাষার মতো সহায়ক আর কিছু নেই। অন্য ভাষা শেখার জন্যও মাতৃভাষার বুনিয়াদ শক্ত হওয়া জরুরি।
মন্তব্য : স্বদেশের ভাষাকে ভালোবাসতে হবে, এর বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে অবাধ করতে হবে এবং বিকৃতিকে রোধ করতে হবে। সুপেয় জল যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি স্বদেশের ভাষা সুমিষ্ট।
লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড
মূলভাব : লাইব্রেরি হচ্ছে জ্ঞানের আধার। একটি জাতির রুচি, জ্ঞানের গভীরতা ও সভ্যতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় ঐ জাতির লাইব্রেরির মাধ্যমে।
সম্প্রসারিত ভাব : একটি জাতি বা দেশের সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলাধুলা-বিনোদন, সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচয়কে ধারণ করে সেই জাতির সযতে তৈরি লাইব্রেরি। কখনো কখনো মানুষের মুখ যেমন ব্যক্তির অন্তর্গত রূপ বা পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে, তেমনি লাইব্রেরি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতিকে চিহ্নিত করে। লাইব্রেরি জাতির অতীত ও বর্তমানকে এক সুতায় বেঁধে রাখে এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেয়। জ্ঞানান্বেষী ও সত্যসন্ধানী মানুষ লাইব্রেরিতে এসে নিজেকে সমৃদ্ধ করে এবং জাতির ক্রমোন্নতিতে ভ‚মিকা রাখে। একটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত সাহিত্যগ্রন্থ দেখে সংশ্লিষ্ট জাতির সাহিত্যরুচি উপলব্ধি করা যায়, বিজ্ঞানগ্রন্থ দেখে জাতির বিজ্ঞান-চিন্তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুভব করা যায়। তাই গ্রন্থাগার হচ্ছে কালের সাক্ষী। জ্ঞান-বিজ্ঞানসংক্রান্ত যেকোনো প্রয়োজনে লাইব্রেরি পরম বন্ধু এবং অনন্ত উৎস। পৃথিবীতে যত বড় বড় আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটির পেছনে রয়েছে লাইব্রেরির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই অনেক বড় বড় যুদ্ধের পরে দেখা গেছে বিজয়ী শক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একটি বৃহৎ লাইব্রেরি জাতির সব ধরনের তথ্যই শুধু সংরক্ষণ করে না, দেশের সঠিক উন্নতিতেও প্রভাবকের ভ‚মিকা পালন করে। লাইব্রেরি মানুষের আনন্দেরও খোরাক জোগায় এবং মানুষের মনকে প্রশান্ত করে। পুস্তক পাঠ মানুষের একটি সৃষ্টিশীল শখ। আর এই শখ পূরণের জন্য লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী।
মন্তব্য : যে জাতি যত উন্নত, সেই দেশের লাইব্রেরি তত সমৃদ্ধ।
বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে
মূলভাব : প্রকৃতির সবকিছুরই একটি স্বাভাবিক সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্য যথোপযুক্ত পরিবেশেই স্বতঃস্ফুর্ত ও আকর্ষণীয়।
সম্প্রসারিত ভাব : সৌন্দর্য প্রকৃতির এক মহামূল্যবান দান। কোথায় সেই সৌন্দর্য সবচেয়ে মানানসই, তা প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দেয়। নির্দিষ্ট পরিবেশের ব্যত্যয় ঘটলে সৌন্দর্যের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য নিপ্রভ হয়ে যায়। বন্য প্রাণীরা বনেই সুন্দর, পাখি মুক্ত আকাশে। ফুল সুন্দর গাছে, মাছ স্বাভাবিক জলে। কিন্তু বন্য প্রাণীকে লোকালয়ে, পাখিকে খাঁচায়, ফুলকে ফুলদানিতে, মাছকে ডাঙায় রাখলে তাদের জীবনের গতি ব্যাহত হয়, সৌন্দর্যের হানি ঘটে, কখনো কখনো জীবননাশের আশঙ্কা তৈরি হয়। প্রত্যাশিত পরিমণ্ডল হারিয়ে এরা নিষপ্রাণ হয়ে ওঠে। শিশুরও যথার্থ স্থান মায়ের কোল। মায়ের কোলে শিশুকে যতটুকু মানায়, অন্য কোথাও তা সম্ভব নয়। নিজেদের শখ-আহ্লাদ পূরণের জন্য মানুষ কখনো কখনো কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে বন্য প্রাণী, পাখি, মাছ পোষার চেষ্টা করে, কিছুটা হয়তো সফলও হয়। কিন্তু এতে সেই সব প্রাণীর জীবনের ছন্দ নষ্ট হয়, বিকাশ ব্যাহত হয়। তাই কৃত্রিমতা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু প্রাণীর আবাস নয়, মানুষের জীবনেও কৃত্রিমতা কাম্য নয়। যে যেখানে উপযুক্ত তাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া উচিত। তাহলে তার প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।
মন্তব্য : যার যেখানে স্থান, তাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া উচিত। প্রকৃত রূপেই সবকিছু সুন্দর, কৃত্রিমতা স্বতঃস্ফ‚র্ততা ও নান্দনিকতার অন্তরায়।
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই
মূলভাব : মানুষে মানুষে অনেক ধরনের বিভেদ-বৈষম্য থাকতে পারে। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে আমরা সবাই মানুষ।
সম্প্রসারিত ভাব : সব মানুষ একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ। পৃথিবীর একই জল-হাওয়ায় আমরা বেড়ে উঠি। আমাদের সবার রক্তের রং লাল। তাই মানুষ একে অন্যের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ভৌগোলিকভাবে আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, অথবা আমরা যে যুগেরই মানুষ হই না কেন, আমাদের একটিই পরিচয়- আমরা মানুষ। কখনো কখনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা জাত-কুল-ধর্ম-বর্ণের পার্থক্য তৈরি করে মানুষকে দূরে ঠেলে দিই, এক দল আরেক দলকে ঘৃণা করি, পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হই। কিন্তু এগুলো আসলে সাময়িক। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, আমরা একে অন্যের পরম সুহৃদ। আমাদের উচিত সবাইকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ রাখা। প্রত্যেককে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া এবং তার অধিকার সংরক্ষণে একনিষ্ঠ থাকা। মানুষের মধ্যে নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, আশরাফ-আতরাফ, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, কেন্দ্রবাসী-প্রান্তবাসী এমন ভাগাভাগি কখনোই কাম্য হতে পারে না। তাতে মানবতার অবমাননা করা হয়। তাই আধুনিককালে এক বিশ্ব, এক জাতি চেতনার বিকাশ ঘটছে দ্রুত। মানবজাতির একই একাত্ম-ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে যুগে যুগে, দেশে দেশে মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ কমে আসবে। মানুষ সংঘাত-বিদ্বেষমুক্ত শান্তিপূর্ণ এক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সর্বত্র মনুষ্যত্বের জয়গাথা ঘোষিত হবে।
মন্তব্য : সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, বিশুদ্ধভাবে ভালোবাসতে পারলেই বিশ্বে প্রার্থিত সুখ ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে।
চরিত্র মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ।
মূলভাব : চরিত্র মানবজীবনের মুকুটস্বরূপ। চরিত্রবান ব্যক্তিকে সবাই শ্রদ্ধা করে; চরিত্রহীনকে সকলে ঘৃণা করে।
সম্প্রসারিত ভাব : চারিত্রিক গুণাবলির মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের মহিমা প্রকাশ পায়। চরিত্রবান ব্যক্তি কতগুলো গুণের অধিকারী হন। সততা, বিনয়, উদারতা, নম্রতা, ভদ্রতা, রুচিশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, লোভহীনতা, পরোপকারিতা ইত্যাদি গুণ চরিত্রবান ব্যক্তিকে মহত্ত¡ দান করে। এসব গুণ যদি মানুষের মধ্যে না থাকে, তাহলে সে পশুরও অধম বলে বিবেচিত হয়। চরিত্রহীন ব্যক্তির মানুষ হিসেবে কোনো মূল্য নেই। চরিত্রবান ব্যক্তি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুণে সমাজে সমাদৃত হন। অন্যদিকে চরিত্রহীন ব্যক্তিকে কেউ ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে না, বরং ঘৃণা করে। চরিত্রবান ব্যক্তি জাগতিক মায়া-মোহ-লোভ-লালসার বন্ধনকে ছিন্ন করে লাভ করেন অপরিসীম শ্রদ্ধা ও অফুরন্ত সম্মান। চরিত্রের মাধ্যমেই ঘোষিত হয় জীবনের গৌরব। চরিত্রবান না হলে অন্য কোনো কিছুই মানুষকে সর্বোত্তম মানুষে পরিণত করতে পারে না। চরিত্রবান ব্যক্তি সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বদা অবিচল থাকে। এতে সে সকলের নিকট শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু চরিত্রহীন কখনো কারো সম্মানের পাত্র হতে পারে না। সে সকল সময় মানুষের ঘৃণাই পেয়ে থাকে। স্বাস্থ্য, অর্থ, বিদ্যা মানবজীবনের অপরিহার্য উপাধান হলেও চরিত্র ছাড়া এগুলোর কোনোটাই কাজে আসে না। তাই চরিত্রের মাহাত্ম্য কখনো মূল্য দিয়ে মাপা যায় না।
মন্তব্য : অর্থ-বিত্ত-গাড়ি-বাড়ি প্রভৃতির চেয়ে চরিত্র অনেক বড় সম্পদ। আর এ মর্যাদা অর্থমূল্যে নয়, মানবিকতা ও নৈতিক পবিত্রতার মানদণ্ডে বিচার করতে হয়। সকলেরই উচিত চরিত্রবান হওয়ার সাধনা করা।
পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি
মূলভাব : সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে কোনো মানুষের জন্ম হয় না। কর্মের মাধ্যমে মানুষ তার ভাগ্য গড়ে তোলে। পরিশ্রমই সৌভাগ্য বয়ে আনে।
সম্প্রসারিত ভাব : যিনি জন্ম দান করেন তিনি প্রসূতি। মা যেমন সন্তানের প্রসূতি, তেমনি পরিশ্রম হলো সৌভাগ্যের প্রসূতি বা উৎস। মানুষকে তার কর্মফল ভোগ করতে হয়। ভালো কাজের ফল ভালো, মন্দ কাজের ফল মন্দ। কোনো কাজই সহজ নয়। আবার কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কঠিন কাজও সহজ হয়। জীবনে উন্নতি করতে হলে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। পরিশ্রম ছাড়া কেউ কখনো তার ভাগ্যকে গড়ে তুলতে পারেনি। জীবনে অর্থ, বিদ্যা, যশ, প্রতিপত্তি লাভ করতে হলে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে। ছাত্রজীবনে কঠোর পরিশ্রম করে শিক্ষালাভ না করলে ভবিষ্যৎ জীবনে সাফল্য লাভ সম্ভব নয়। পরিশ্রম ছাড়া জাতীয় উন্নতিও লাভ করা যায় না। পৃথিবীতে এমন একটি জিনিসও নেই যা শ্রমলব্ধ নয়। আমাদের সমাজ ও সভ্যতা বর্তমান পর্যায়ে আসার মূলে রয়েছে পরিশ্রম। যুগ যুগ ধরে তিল তিল পরিশ্রমের মাধ্যমে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। মানব কল্যাণে আবিষ্কারকগণ পরিশ্রম করে আবিষ্কার করেছেন বিভিন্ন সূত্র। পরিশ্রম না করে অলস বসে থাকলে কখনো ভালো ফল এসে ধরা দেয় না। ভালো ফল ধরা দেয় তখনই যখন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ফলাফলকে নিজের করে নিতে হয়।
মন্তব্য : শ্রমই হলো উন্নতির চাবিকাঠি। যে জাতি পৃথিবীতে যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত উন্নত। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই জাতির অগ্রগতি অর্জন করা যায়।
ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়
মূলভাব : জীবন কর্মময়। কর্মশক্তির মূলে রয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর প্রবল আগ্রহ। আগ্রহের সঙ্গে নিষ্ঠা যুক্ত থাকলে অসাধ্যকেও সাধ্য করা যায়।
সম্প্রসারিত ভাব : মানুষকে সব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করে তার ইচ্ছাশক্তি। প্রতিদিনই আমাদের কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। পৃথিবীতে কোনো কাজই বিনা বাধায় করা যায় না। সব কাজেই কিছু না কিছু সুবিধা-অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি থাকে। সেই অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে পারলেই সাফল্য আসে। এজন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছা। ইচ্ছা থাকলে কোনো কাজ আটকে থাকে না। ইচ্ছাই সকল কর্মের প্রেরণা। ইচ্ছাই মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দৃঢ় ইচ্ছার কাছে সকল বাধা হার মানে। প্রবল ইচ্ছা নিয়ে কোনো কাজ করলে অতি কঠিন কাজও শেষ করা যায়। পৃথিবীর মহান ব্যক্তিরা এভাবেই সব ধরনের বিপত্তি অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। সম্রাট নেপোলিয়ন তাঁর সেনাবাহিনীসহ আল্পস পর্বতের কাছে গিয়ে অসীম উৎসাহে বলে ওঠেন : ‘আমার বিজয় অভিযানের মুখে আল্পস পর্বত থাকবে না।’ আত্মশক্তি ও ইচ্ছাশক্তির বলে তিনি আল্পস পার হতে পেরেছিলেন। অসাধ্যকে সাধন করতে পেরেছিলেন প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে।
মন্তব্য : মানুষের সকল কাজের মূল হলো ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাই মানুষকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে দেয়।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।
মূলভাব : মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে বেঁচে থাকতে হয়।
সম্প্রসারিত ভাব : সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষের জীবন অর্থহীন। কারণ, সমাজে প্রতিটি মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি কেবল নিজের কথা ভাবে, সমাজের কথা ভাবে না, সে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ কখনোই সুখী হয় না। যারা নিজের কথা না ভেবে সমাজের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেয় তারাই প্রকৃত মানুষ। অন্যের সুখের জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার করে, তাদের মতো সুখী আর কেউ নেই। সমাজে এ রকম মানুষেরাই চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসাই প্রকৃত মানবধর্ম। আজকের এই সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে মানুষের শুভবুদ্ধি ও অন্যের কল্যাণ করার ইচ্ছা। আর অন্যের কল্যাণ করার এই ইচ্ছা ব্যক্তিকে সকলের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় করে তোলে। সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার মাঝে রয়েছে প্রকৃত সুখ। পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মাঝে রয়েছে মানবজীবনের চরম সার্থকতা। আমরা শুধু নিজের জন্যই জন্মগ্রহণ করিনি, নিজের সুখই আমাদের একমাত্র কাম্য হতে পারে না। অন্যের কল্যাণই মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে তোলে। আর এটিই সকলের একমাত্র কাম্য হওয়া প্রয়োজন।
মন্তব্য : ত্যাগের মাঝেই জীবনের সার্থকতা নিহিত, ভোগের মাঝে নয়।
কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?
মূলভাব : পৃথিবীতে যেকোনো কাজে সাফল্য লাভ করার জন্য প্রয়োজন ঐকান্তিক সাধনা ও নিষ্ঠা; প্রয়োজন সকল প্রতিক‚লতাকে জয় করার মনোবল ও সহ্যশক্তি। দুঃখ-কষ্ট বা পরিশ্রমের ভয়ে কাজ থেকে বিরত থাকা অনুচিত। কেননা দুঃখ ছাড়া সুখ লাভের কোনো উপায় নেই।
সম্প্রসারিত ভাব : হৃদয়গ্রাহী সৌন্দর্যের কারণে ফুল সবার কাছে প্রিয়। কিন্তু তার গায়ে রয়েছে কাঁটা। তাকে পেতে হলে অতিক্রম করা দরকার কাঁটার বাধা। ফুল সংগ্রহকারীকে সহ্য করতে হবে কাঁটার আঘাত। এ আঘাতে হাত ক্ষতবিক্ষত হওয়াও বিচিত্র নয়। যিনি এ আঘাতের কষ্টটুকু বরণ করতে প্রস্তুত, তিনি অবশ্যই কমল পেতে পারেন। পৃথিবীতে মানুষের চলার পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনের পূর্বশর্ত এই কণ্টকাকীর্ণ দুঃখময় পথে সমস্ত প্রতিক‚লতাকে হাসিমুখে বরণ করে অগ্রসর হওয়া। দুঃখকে বরণ করতে না শিখলে সুখ অর্জন করা সম্ভব নয়। কাঁটার আঘাতের ভয়ে কেউ পদ্মফুল সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকলে, তার পক্ষে কখনোই পদ্মফুল সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। ক্লান্তির ভয়ে পথিক ভীত হয়ে পড়লে তার পক্ষে কখনও গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তাই জীবনে চলার পথের সকল প্রতিক‚লতাকে তুচ্ছজ্ঞান করে দৃপ্ত সংকল্পে মানুষকে অগ্রসর হতে হয় ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য।
মন্তব্য : ফুলের শোভা মনভরে উপভোগের জন্য কাঁটার আঘাত সইতে হয়। তেমনিভাবে জীবনে সুখলাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে দুঃখকে হাসিমুখে বরণ করে নিতে শেখা। শ্রমকে ভয় পেলে জীবনে সাফল্য আসে না। জীবনে কোনো মহৎ প্রাপ্তিই ত্যাগ-তিতিক্ষা ছাড়া অর্জিত হয় না।
দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য।
মূলভাব : দুর্জনের স্বভাব-ধর্ম অন্যের ক্ষতি করা। তাই কোনো শিক্ষিত লোক যদি চরিত্রহীন হয়, তবে অবশ্যই তার সঙ্গ পরিহার করা উচিত। কারণ, তার কাছ থেকে উপকার পাওয়ার চেয়ে বরং ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
সম্প্রসারিত ভাব : মানুষ্যত্ববিরোধী কৃপ্রবৃত্তিগুলো দুর্জন লোকের নিত্যসঙ্গী। এই ধরনের ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র দুর্বল। সমাজ, দেশ বা জাতি কেউ এদের দ্বারা উপকৃত হয় না। এরা সমাজের কলঙ্ক। এরা আত্মকেন্দ্রিক, লোভী এবং স্বার্থপর। কোনো কোনো দুর্জন লোক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয় বটে, কিন্তু বাস্তবে হয় না জ্ঞানী। তাদের শিক্ষার সার্টিফিকেট একটি কাগজ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সার্টিফিকেট-সর্বস্ব শিক্ষা এদের চরিত্র ও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এরা শিক্ষিত হয়ে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। চাতুরি ও ছলনায় আরও ক‚টকৈৗশলী হয়ে এরা সহজ-সরল মানুষকে প্রতারিত করে। এদের সাহচর্যে সততার অপমৃত্যু ঘটে। মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ তার চরিত্র। মানুষের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে অপরাপর বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটানো আবশ্যক। তেমনি, বিদ্বান হওয়াও একটি গুণ। বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে। বিদ্বানের সংস্পর্শে এলে জ্ঞানের আলোয় মন আলোকিত হয়। কিন্তু বিদ্বান ব্যক্তি যদি চরিত্রহীন হয়, তবে তার বিদ্যার কোনো মূল্য থাকে না। সে তার বিদ্যাকে অন্যায় কাজে লাগায়। এরা নিজের স্বার্থ বা অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য যেকোনো কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। চরিত্রহীন বিদ্বান ব্যক্তির কাছ থেকে বিদ্যা লাভ করে জীবনে কোনো কল্যাণ সাধন করা যায় না। তাই দুর্জন যদি বিদ্বানও হয়, তবু তার সান্নিধ্য ও সংশ্রব ত্যাগ করাই মঙ্গলজনক।
মন্তব্য : বিদ্যা অমূল্য ধন। কিন্তু এ ধন অর্জনকারী ব্যক্তি চরিত্রহীন হলে তা অসৎ উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে পারে। তাই তার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।
WhatsApp Channel
Join Now
Telegram Group
Join Now