মাযহাবের ভিন্নতা কি ধর্মের বিভক্তি? (What is the difference between the schools of religion?)

0

হজ্ব থেকে ফেরার পর কোনো এক হাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হলো, মক্কায় কেমন দেখলেন? তিনি একটু ভাব নিয়ে বললেন, মক্কায় গিয়ে দেখি, খালি আযানটা দেয় বাংলায়, আর বাকি সবই কেমন যেন মনে হলো।

বেচারা হাজী সাহেব যে আযান সবসময় নিজের গ্রামে শোনেন, সে আযানই মক্কায় শুনতে পেয়ে ভাবলেন, এটা তো বাংলাদেশের বাংলা আযান। বাকি নামায অন্যান্য ইবাদত তো অন্যরকম- তাই এ নিয়ে তিনি সন্দিহান।

সাধারণত বাংলাদেশের কোনো মসজিদে যদি কেউ হানাফি ছাড়া অন্য মাযহাবের নিয়মে নামায পড়ে তবে সবাই হা করেতাকিয়ে থাকে, কেউ কেউ ভাবে, আহা বেচারা! কী কষ্ট করে ভুল নামায পড়ছে!!

কিন্তু ইসলামের চারটি মাযহাব রয়েছে:

১.    হানাফী- ইমাম আবূ হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি।

২.    মালেকী- ইমাম মালেক বিন আনাস রহমাতুল্লাহি আলাইহি।

৩.    শাফেয়ী- ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।

৪.    হাম্বলী- ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি।

আমরা বাংলাদেশিরা প্রায় সবাই হানাফী মাযহাবের মতে আমল করি। কিন্তু তাই বলে কি বাকি তিনটি মাযহাব অন্য ধর্মের মতো ভিন্নরকম? তাদের ইবাদতও কি আমাদের মত শুদ্ধ ও কবুল হয়? তাদের সাথে কি বিয়ে শাদী ও অন্যান্য লেনদেন বৈধ?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে নামায আদায় করেছেন। সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে যখন যে যেভাবে দেখেছেন, তারা সেভাবেই নামায পড়তেন। অন্যান্য ইবাদতের বেলায়ও তাই। যে সাহাবি যে পদ্ধতি রাসূলের কাছ থেকে শিখেছেন ও দেখেছেন, তিনি বাকি জীবন ওভাবেই আমল করেছেন। এ পার্থক্য শুধু অর্থ অনুধাবনে ও আদায়ের পদ্ধতিতে, অন্য কিছু নয়।

তার মানে কিন্তু এই নয় যে, কেউ এক রাকাতে দুই রুকু কিংবা তিন সিজদা করেছেন। রমযানের রোযা কেউ কম বা বেশি রেখেছেন, যাকাতের হিসেবে চল্লিশ ভাগের একভাগের চেয়ে কেউ কম বা বেশি করেছেন- এমন কিছুই নেই। যেটুকু পার্থক্য রয়েছে- তা কেবলই আদায় করার পদ্ধতি নিয়ে। কোনো সন্দেহ নেই যে এর সবগুলোই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা আদায় করেছেন, তবে বর্ণনাগত দূরত্ব বা নৈকট্যের তারতম্যে চার ইমাম সেখান থেকে কোনো একটিকে বাছাই করেছেন। কখনো কখনো বহু অর্থবোধক শব্দের আসল অর্থ নির্ধারণের তারতম্যে ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। কেউ আভিধানিক অর্থ নিয়েছেন কেউ পরিভাষার অর্থ। তাই কোনো এক মাযহাব সঠিক আর বাকিগুলো ভুল- এমন ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব।

ইমামরাও তাদের মাযহাবের কোনো বিষয়ে সন্দেহ থাকলে কুরআন, হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামদের বর্ণনায় যেটি সর্বাধিক সহি সেটি গ্রহণ করার কথা বলেছেন।

তাই বলে কি আমরা সুবিধা মত সব মাযহাবের ওপর আমল করা শুরু করব? না, তা নয়। কারণ এতে দ্বীন ও ইবাদত আমাদের সুবিধামত খেলার উপকরণে পরিণত হবে। বরং যে যে মাযহাবের পদ্ধতি শিখেছে, তার সেভাবেই পুরো দ্বীন মানা উচিত।

এ কথাও মনে রাখতে হবে, হানাফী মাযহাবের অনুসারী মানে কিন্তু ইমাম আবু হানিফার অনুসরণ নয়, আমরা ইমাম আবু হানিফার মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা কেই অনুসরণ করছি। ইমাম এখানে নিছক মাধ্যম ছাড়া আর কিছু নন।

কুরআন ও সুন্নাহর বিশাল সাগর পাড়ি দেওয়া আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এর পথ ও পদ্ধতি রপ্ত করাও দুঃসাধ্য বিষয়। তাই সাধারণ মুসলমানদের জন্য চার ইমামের চার মাযহাব হল নৌকার মতো। এ নৌকাগুলোর মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে দ্বীনের সাগর পাড়ি দিয়ে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির বন্দরে ভিড়ে।

এখন যদি এ নৌকাগুলোর যাত্রী সাগর পাড়ি দেওয়া বাদ দিয়ে পারস্পরিক ধাক্কাধাক্কি ও ঠুকোঠেুকিতে লিপ্ত হয় তবে ছিটকে পড়ে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া উপায় নেই, তীরে আর পৌঁছা যাবে না। মাযহাব নিয়ে অশ্রদ্ধা ও পারস্পরিক বিতর্ক ও সংঘাতের ব্যাপারটি ঠিক এমনই।

তবে কেউ যদি কুরআন ও হাদীসের এবং ইসলামী শরীয়তের মূল ভিত্তিগুলো সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান ও পা-িত্যের অধিকারী হয় এবং নিজের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা থাকে- তখনই কেবল মাযহাব ছেড়ে দিয়ে নিজের ইজতিহাদ মতো আমল করা যাবে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে আসলে এ চার মাযহাবের মাধ্যমে আল্লাহ পাকের বিধান ও রাসূলের সুন্নাতের সব পদ্ধতি ও রকমের অনুসরণ হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। এটা কুদরতি এক নিদর্শন। বিশ্বের সব মুসলমান এক পদ্ধতিতে নামায পড়লে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর অন্য পদ্ধতিগুলো হারিয়ে যেত। পবিত্র কুরআনের সাত ক্বেরাত পদ্ধতির মতো এ চার মাযহাবও এ উম্মতের জন্য রহমত। কুরআন ও সুন্নাহ থেকেই এগুলোর উৎপত্তি।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা একবার সফরে রওয়ানা হওয়ার আগে বললেন, সবাই যেন বনু কুরাইযার অঞ্চলে গিয়ে আসর নামায পড়ে। কোনো কোনো সাহাবি ভাবলেন, রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এ কথা বলার কারণ হল- যেন পথে দেরি না হয়। তাই তারা দেরি না হওয়ার মতো করে পথেই আসর আদায় করে ফেললেন। আর একদল ভাবলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা স্পষ্ট করে যা বলেছেন, সেটাই মানা ভাল। তারা সেখানে পৌঁছে আসর আদায় করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর আগে ও পরে আদায়ের কথা শুনে দু’টোকেই ঠিক বললেন এবং পথে আদায়কারীদের নামায পুনরায় আদায় করতে বলেননি।

সাহাবারা এ ঘটনায় যেমন রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা উদ্দেশ্য অনুধাবন নিয়ে দু’ভাগে ভাগ হয়েছিলেন, চার মাযহাবে ভিন্নতা ঠিক এ রকমই। কিন্তু মৌলিক ও স্পষ্ট বিষয়সমূহে সবাই সম্পূর্ণ একমত এবং যেটুকু ভিন্নতা রয়েছে- তা নিয়ে তারা কোনোদিন বিবাদ কিংবা গালমন্দ তো দূরের কথা- সামান্য তাচ্ছিল্যও দেখাননি। কারণ কোনো এক মাযহাবকে নিয়ে ঠাট্টা করা মানে স্বয়ং রাসূলের একটি পদ্ধতি বা বর্ণনাকে তুচ্ছ করা।(যা কিনা কুফুরীর শামিল)

আর তাই নিজেদের ইবাদত আদায়ের সময় নিজের মাযহাব সম্পর্কে জানা এবং সঠিকভাবে তা আদায় করাই সচেতন মুসলমানের কাজ। পদ্ধতির এ ভিন্নতাকে যদি কেউ ধর্মের বিভক্তির মতো মনে করে এবং এ নিয়ে তালগোল পাকায়- তবে ভ্রান্তির উত্তাল সাগরে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া তার কোনো সমাধান নেই।

আসুন, ছোটবেলায় নানা দাদারা কে কী বলেছেন, মক্তবের হুজুর কী শিখিয়েছিলেন- সেসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে যার যার মাযহাব সম্পর্কে আলেমদের কাছ থেকে সঠিক জ্ঞান অর্জন করি এবং আদায় করি। যে কোনো বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ আলেমের কাছ থেকে জেনে ইসলাম মানার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ পাক দিয়ে রেখেছেন পবিত্র কুরআনে- ‘আর তোমরা যদি না জানো তবে অভিজ্ঞ কাউকে জিজ্ঞেস করে নাও-’(নাহল-৪৩)।

Post a Comment

0Comments

Assalamu Alaikum Wa Rahmatullah
Greetings!
Provide your feedback.

Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !