হযরত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (Short biography of Hazrat Imam Ghazzali (RA))

Join Telegram for More Books
Table of Contents

ইমাম গাজ্জালী রঃ এর নাম আসল নাম আবু হামিদ মুহম্মদ।তাহার পিতার ও পিতামহ উভয়ের নামই মুহম্মদ। তিনি খোরাসানের অন্তর্গত তুস নগর এর গাজালা নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন। তাই সবাই উনাকে গাজ্জালী নামেই চিনে।

ইমাম গাজ্জালী রা: এর যুগে পারস্যের সম্রাট ছিলেন সলজুক বংশীয় সুলতান রুকনুদ্দীন তোগরল বেগ। সলজুগ বংশীয় সুলতাংনের রাজত্বকাল মুসলমানদের চরম উন্নতির যুগ ছিল। তাহাদের পুর্বে ইরান শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত বুইয়া বংশীয় রাজাদের শাসনাধীন ছিল।এই সময় মুসলিম শক্তি সমুহ পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ,আক্রমন-প্রতিআক্রমনের ফলে দুর্বল হয়ে পরেছিল। কিন্তু সলজুক বংশীয় তুর্কীগন ইসলাম গ্রহন করলে তাদের প্রাক ইসলামী স্বভাব চরিত্র ও মুল্যবোধে বিড়াট পরিবর্তন সাধিত হয় এবং তাদের মাধ্যমে এক অনুপম সভ্যতা গড়ে উঠে। ফলে তারা মুসলিম বিশ্বের লুপ্ত প্রায় শক্তি ও প্রতিভাকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম হয়। এই শক্তির অভ্যুদয়ের ফলে খ্রীষ্টান শক্তির অগ্রগতি রহিত হয় এবং সমগ্র অশিয়ার এক বিড়াট অংশ এই সুলতান গনের অধীনে এসে পড়ে। যুগে মুসলমানদের বিদ্যার্জন স্পৃহা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায় । তৎকালে প্রচলিত ইহুদী ,খৃষ্টান ও পারসিকদের জ্ঞানার্জন সমাপ্ত করে প্রাচীন গ্রীক,মিশরীয় ও ভারতীয় জ্ঞানারহনে তারা প্রবৃত্ত হন।এ জন্যই জ্যোতিসশাস্ত্র, জড়বাদ, নাস্তিকতা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের মতবাদের সংমিশ্রনে মুসলমান সমাজে বহু মতানৈক্যের এবং ইসলামী বিশ্বাস ও জ্ঞানের সাথে নানারকম মারাত্বক অনৈসলামিক ধর্ম-বিশ্বাস ও জ্ঞান এমন ভাবে মিশে পড়ে যে,খাটি ইসলামী বিশ্বাস ও অনইসলামী বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য করাই দুরহ হয়ে পড়ে। অত্যধিক পরিমানে পার্থিব জড়বাদের প্রভাবে ধর্ম জ্ঞানের শ্বাস প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় এবং মুসলমান সমাজে ইসলামী বিশ্বাস ও ধর্মকার্যের ক্ষেত্রে এক চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। ইহা হতে সমাজকে মুক্ত ও রক্ষা করার দায়িত্বই ইমাম গাজ্জালী রঃ এর উপর অর্পিত হয়।এই ক্ষনজন্মা মহাপুরুষের অতুলনীয় প্রতিভা যে নিপুনতার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন, তাহা সমগ্র বিশ্ব বিস্বয় ও ভক্তিভরে আজীবন স্বরন করবে।

তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্হা-
তৎকালে মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রথমিক স্তর হতে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্টিত ছিল। ছাত্রগনের খাওয়া পরার খরচ সহ মাদ্রাসার সমস্ত খরচ সরকার বহন করতেন। তদুপরি সকল মসজিদ ও বহু সঙ্গতিসম্পন্ন লোকদের গৃহেও মাদ্রাসা ব্যবস্থা চালু ছিল। সুতরাং সেইকালে ধনী দরীদ্র সকলের নিকটই শিক্ষার পথ সুগম ছিল। প্রবীন ও উচ্চশিক্ষিত সুধীজন যে সকল স্হানে শিক্ষাদান করতেন ,সেসব স্হানই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পরিনত হত।

শৈশবকাল ও ছাত্র জীবন-

ইমাম গাজ্জালী র: এর পিতা ছিলেন দরিদ্র।তথাপি তিনি পুত্রের শিক্ষার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি।ইমাম গাজ্জালী র: শৈশব কালেই পিতৃহীন হন।অন্তিম কালে তার পিতা তাহার জনৈক বন্ধুর কাছে দুই পুত্র আহমদ ও মুহম্মদ এর প্রতিপালনের ও শিক্ষার ভার অর্পন করেন এবং এ জন্য সামান্য অর্থ প্রদান করেন। শিশুদ্বয় অসাধারন মেধার অধিকারী ছিলেন।অতি অল্পকালের মধ্যেই পবিত্রকোরান হিফজ সমাপ্ত করে তারা শহরের একটি মাদ্রাসায় ভর্ত হন।আল্লামা আবু হামিদ আসকারায়েনি, আল্লামা আবু মুহম্মদ যোবায়নি প্রমুখ মহাজ্ঞানী উস্তাদের নিকট তিনি শিক্ষা লাভ করেন।খ্যাতনামা ফিকাহ শাস্ত্রবিদ আল্লামা আহমদ বিন মুহম্মদ রাযকানীর নিকট তিনি ফিকাহশাস্ত্রের প্রাথমিক কিতাবসমুহ অধ্যয়ন করেন।

উচ্চ শিক্ষার জন্য জুরজানে গমন গমন-

তাহেরানে শিক্ষা সমাপ্তির পর ইমাম গাজ্জালী র: উচ্চ শিক্ষার জন্য জুরজান শহরে গমন করেন।এখানে তিনি হযরত ইমাম আবু নসর ইসমাইল র: এর তত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহন আরাম্ভ করেন।তার তীক্ষ্ণমেধা ও অসাধারন প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তিনি পুত্রবৎ স্নেহে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাকে শিক্ষাদানে প্রবৃত্ত হন।তৎকালে শিক্ষকগন পাঠ্যবিষয়ে যে বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন তা শিক্ষার্থিদেরকে হুবহু লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য করা হতো।এ লিখিত নোটগুলিকে ”তালিকাত” বলা হত। এরুপে ইমাম গাজ্জালী র: এর কাছে তালিকাতের এক বিড়াট ভান্ডার সংগৃহিত হল।

তাহেরানা অভিমুখে যাত্রার পথে সর্বস্ব লুন্ঠন-

জুরজানে অধ্যয়ন সমাপনান্তে ইমাম গাজ্জালী র: জন্মভুমি তাহেরান যাত্রা করেন। পথিমধ্যে দস্যুদল তালীকাত সহ তার সমস্ত কিছু লুন্ঠন করে নেয়।টাকা পয়সা ও অন্যান্য সম্পদ লুন্ঠন হওয়াতে তিনি কোন কষ্ট অনুভব করলেন না । কিন্তু তালিকাত অপহরনে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েলেন। তাই দস্যুসরদারের নিকট অন্তত তাহার সমস্ত অর্জিত বিদ্যার সন্চ্ঞয় সম্ভার তালিকাত গুলি ফেরত দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন।দস্যু সরদার তাকে উপহাসের স্বরে বলল। “তুমিতো বেশ বিদ্যাঅর্জন করেছ! সবই কাগজে রয়েছে, মনে কিছু নেই। এই কথা বলে সে তার সমস্ত তালিকাত ফিরিয়ে দিল। সরদারের ব্যঙ্গোক্তি ইমাম গাজ্জালী র: এর মনে দাগ কাটল। পরে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সমস্ত তালিকাত মুখস্ত করে নেন।

নিজামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন-

খোরাশানের অন্তর্গত নিশাপুরে অবস্থিত নিজামিয়া মাদ্রাসা তৎকালে বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। জুরাজানের অধ্যয়ন শেষে ইমাম গাজ্জালী র: এর জ্ঞান পিপাসা নিবৃত হল না। তাই তিনি নিযামিয়া মাদ্রাসায় গমন করলেন। সেখানে তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আলিমরুপে স্বীকৃত ইমামুল হারামাইন র:ছিলেন এই মাদ্রসার অধ্যক্ষ।দুনিয়ার বহু দেশ হতে বহু লোক উচ্চশিক্ষার জন্য উনার নিকট উপস্হিত হতেন। তিনি এত গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ হতে সুলতানগনও বিভিন্ন জটিল বিষয়ের মিমাংসার জন্য তার নিকট উপস্থিত হতেন। ইমাম গাজ্জালী র: উপযুক্ত শিক্ষক পেয়ে তার তীব্র জ্ঞান পিপাসা মিটাতে লাগলেন। ইমামুল হারামাইনও ইমাম গাজ্জালী র: কে দর্শন ও জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে খুব আগ্রহের সহিত শিক্ষা দিতে লাগলেন।
৪৭৮ হিজরিতে ইমামুল হারামাইন র: ইন্তিকাল করেন। তিনি ছাত্রগনের নিকট এত প্রিয় ছিলেন যে,তাহারা তাহার মৃত্যুতে প্রায় উন্মাদ হয়ে পড়ে। ছাত্রগন প্রায় এক বৎসর কাল উস্তাদের শোকে মুহ্যমান হয়ে থাকে। ইমামা গজ্জালীর নিকটও উস্তাদের তিরোধান যাতনা অসহনীয় হয়ে উঠে এবং নিশাপুর তার নিকট অন্দ্ধকার পুরীর ন্যয় মনে হতে লাগলো। তাই তিনি নিশাপুর পরিত্যগ করে বাগদাদ চলে আসেন ও ওখানেই পড়া লেখা শেষ করেন।

দিব্যজ্ঞান বা তাজকিয়ায়ে নফস অর্জনে বাইয়াত গ্রহন-

এই সময় ইমাম গাজ্জালী র: এর বয়স ছিল মাত্র ২৮ বৎসর। তিনি জানতেন যে কেবল কিতাব পাঠ আল্লাহর জ্ঞান লাভের জন্য যথেষ্ঠ নয়। ইহার জন্য দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন জীবন্ত উস্তাদের নিতান্ত প্রয়োজন। হাদিস শরীফে আছে জ্ঞান দুই প্রকার । এক প্রকার জ্ঞান হচ্ছে জবানী জ্ঞান, অন্য একটি ক্বলবী এলেম বা আত্বিক জ্ঞান। রাসুল পাক (সাঃ)বলেন ক্বলবী এলেম বা আত্বিক জ্ঞানই হচ্ছে উপকারী জ্ঞান(মেশকাত শরীফ)। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন, “আমি রসুল পাক(সাঃ) এর কাছ থেকে জ্ঞানের দুটি পাত্র অর্জন করেছি। একটি তোমাদের মধ্যে বিতরন করেছি অন্যটি করিনি।যদি করতাম তবে আমার কন্ঠদেশ কর্তিত হতো” (বোখারী শরীফ) পবিএ কালাম পাকে ইহাকে তাজকিয়া এবং হাদিস শরীফে ইহাকে এহসান নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হুজুর পাক (সাঃ) এর বহুমুখি শিক্ষার মধ্যে এই তাজাকিয়াও ছিল একটি অন্যতম বিষয় ।কালামে পাকে এরশাদ হচ্ছে “তিনিই উম্মিদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরন করেছেন , যিনি তাদেরকে তাজকিয়া করেন এবং কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন। যদিও ইতিপূর্বে তারা গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল” (সুরা জুমায়া ২) হজরত ইমাম মালিক (রাঃ) বলেছেন ”যিনি তাসাউফ গ্রহন করলেন কিন্তু ফিকহ গ্রহন করলেন না তিনি নিশ্চই কাফের । আর যিনি ফিকহ গ্রহন করলেন কিন্তু তাসাউফ গ্রহন করলেন না, তিনি নিশ্চয়ই ফাসেক। আর যিনি উভয় জ্ঞান গ্রহন করলেন এবং সেই অনুযায়ী আমল করলেন তিনিই মুহাক্কেক বা প্রকৃত দ্বীন গ্রহণ করলেন।” তাই তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত দিব্যজ্ঞান বা এলমে তাসাউফ ধারী বুযুর্গ কামেল হযরত শায়েখ আবু আলী ফারমেদী র: এর হস্তে বাইয়াত হয়ে দিব্য জ্ঞান আহরন করতে থাকেন।

মাদ্রাসার নিযামিয়ার অধ্যক্ষ পদে ইমাম সাহেব (র)

বাগদাদে তখন তুর্কিরাজ মালেক শাহের আধিপত্য ছিল । তাহার প্রধানমনত্রী হাসান বিন আলীনিযামুল মুলক একজন অসাধারন পন্ডিত ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন । তাহার নিয়মানুসারেই বাগদাদের বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ‘মাদরাসায়ে নিযামিয়া’ এবং উহার পাঠ্যতালিকা ‘দরসে নিযামী’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে হযরত ইমাম সাহেবকে মাদরাসার অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করেন। তখন তাহার বয়স মাত্র ৩৪ বছর, এত অল্প বয়সেও তিনি অধ্যাপনা ও পরিচালনা কার্যে নিতান্ত দক্ষতা ও নিপুনতার পরিচয় প্রদান করেন। স্বয়ং বাদশাহ ও রাজপুরুষগণও রাজকার্যের জটিল সমস্যাসমূহে তাহার পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এ সময় তার নাম দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন দেশ হতে শত শত ছাত্র তার শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য ছুটে আসেন। মাদ্রাসা নিযামিয়ার খ্যাতিও অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অধ্যাপনার সাথে সাথে তিনি নানা জটিল বিষয়ে গবেষণাও করতে থাকেন। এরুপে তিনি অপরিসীনম জ্ঞানের অধিকারী হন।

মাদ্রাসা নিযামিয়া পরিত্যাগ

প্রভূত যশ ও যোগ্যতার সহিত ইমাম গাযযালী (র) চার বৎসরকাল মাদ্রাসা নিযামিয়াতে কাজ করেন। নানা জটিল বিষয়াদির চমৎকার ব্যাখ্যা শ্রবণ এবং তাহার জ্ঞাণের গভীরতা উপলব্ধি করে তার ছাত্রগণ একেবারে বিস্মিত হয়ে পড়ত। এখানে অবস্থানকালে তিনি দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্হরাজি অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। তথাপি তাহার মন পরিতৃপ্ত হল না। কিসের অভাবে যেন তাহার মন আনচান করতে লাগলো। অজানাকে জানার এবং অদেখাকে দেখার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। যাবতীয় কর্মের প্রতি তার মন বিতৃষ্ন হয়ে উঠলো। তনি ব্যাকুল বুঝলেন যে, কেবল পুথিগত জ্ঞান দ্বারা বিশেষ কোন কাজ হয় না। বিশুদ্ধ জ্ঞানের সাথে সাথে একাগ্র সাধণা ও রিয়াযত আবশ্যক। এ সম্পর্কে তিনি নিজে বলেন : ”মানুষের সদ্‌গুনরাজির বিকাসের জন্য অক্লান্ত সাধনা ও একনিষ্ঠ সংযমের একান্ত আবশ্যক।” এই উপলব্ধির পর স্বীয় স্বভাব ও কর্মের প্রতি মনোনিবেশপূর্বক দেখিলাম, আমার কোন কাজই এই নীতির অনুরুপ নহে, যাহার দ্বারা আমার স্বভাব,আত্না ও মানবতার উন্নতি সাধন হইতে পারে। আমি আরও বুঝতে পারলাম যে,আমি প্রবৃত্তির বশবর্তি হয়ে কাজ করছি এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য আমার কোন কাজ হচ্ছে না। তবে আল্লাহর সন্তোষ লাভের নিমিত্ত লোকালয়ে অবস্থান করেই দুনিয়ার সকল মোহ বর্জন করতে হবে। এইরুপ চিন্তা করতে করতে যাবতীয় কর্মের প্রতি আমার বিতৃষ্না ও বইরাগ্যভাব জন্ম নিতে লাগলো। মাদ্রাসার অধ্যাপনা ও পরিচালনার কাজেও শৈইথিল্য দেখা দিল ,মৌনাবলম্বনের স্পৃহা বৃদ্ধি পেল; হযম শক্তি কমতে লাগলো এবং ঔষধেও অশ্রদ্ধা জন্ম নিল। চিকিৎসকগন বললেন,” এমতাবস্থায় কোন ওষুধই ফলপ্রদ হবে না।” অন্তর দেশ ভ্রমনে বাহির হওয়ার মনস্থ করলাম। দেশের আমীর-উমরাহ,আলিম-উলামা, সুধীমন্ডলী এবং রাজপুরুষগণ এই সংকল্প পরিত্যাগের জন্য আমাকে অনুরোধ করতে লগলেন। কিন্তু আমি মনকে বশে আনতে পারলাম না। পরিশেষে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে হিজরী ৪৮৮ সনের যিলক্বাদা মাসে আমি গোপনে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হলাম।

হযরত ইমাম গাজ্জালী র: এক অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে জন্ম গ্রহন করেছিলেন। জাগতিক জ্ঞান তার মনের তীব্র পিপাসা মিটাতে পারেনি। তাই তিনি এবার আধ্যাতিক জ্ঞানের অন্যেষনে বেড়িয়ে পড়লেন। শৈশব থেকেই তার ধর্মের প্রতি অনুরাগ ও জ্ঞান পিপাসা ছিল অত্যন্ত প্রবল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সকল দার্শনিকদের মতবাদও তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু উহাতেও তার মনের কোন খোরাক মিটলো না। তাই এক অজ্ঞাত রহস্যের সন্ধানে সংসারবিরআগী সুফী-দরবেশের বেশে জীবনের দশটি বৎসর নানা দেশ পর্যটনে তিনি অতিবাহিত করেন। এই পথেই তিনি তার জীবনের চির আকাঙ্খিত রহস্যের সন্ধান খুজে পান। তার মন চিররহস্যময় আল্লাহর স্বরূপ উদঘাটনে সমর্থ হয় এবং তার অন্তরের পিপাসা নিবারিত হয়।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক ও আলেমে দ্বীন ইমাম আবু হামেদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-গাজ্জালী র: জীবনের প্রথম দিকে ছিলেন শাসন কর্তৃপক্ষের নৈকট্যপ্রাপ্ত একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। অন্যান্য আমীর ওমরাহগনের মতই তারও জীবনযাত্রা ছিল বর্নাঢ্য। কিন্তু ভোগ বিলাসপুর্ন জীবনযাত্রার মধ্যেও তার ভেতরে লুকিয়ে ছিল মুমিনসুলভ একটি সংবেদনশীল মন,যা সমকালীন মুসলিম জনগনের ব্যাপক স্খলন-পতন লক্ষ্য করে নীরবে অশ্রুবর্ষন করতো। ইহুদী-নাসারাদের ভোগ সর্বস্ব জীবনযাত্রার প্রভাবে মারাত্নকভাবে আক্রান্ত মুসলিম জনগনকে ইসলামের সহজ সরল জীবন ধারায় কি করে ফিরিয়ে আনা যায়, এ সম্পর্কে তিনি গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতেন। কোন কোন সময় এ চিন্তাভাবনা তাকে আত্নহারা করে ফেলতো। ভাবনা চিন্তার এক প্রর্যায়ে এ সত্য তার দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো যে ,বর্তমানে মৃতকল্প মুসলিম জাতিকে নবজীবনে উজ্জীবিত করে তোলা একমাত্র দ্বীনের স্বচ্ছ আবে হায়াত পরিবেশনের মাধ্যমেই সম্ভব।আর তা বিলাশপুর্ন জীবনের অর্গলে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখে হাতে পাওয়া সম্ভব নয়।এ উপলব্ধিতাড়িত হয়েই ইমাম গাজ্জালী র: একদিন পরিবার পরিজন এবং ঘর-সংসার ত্যগ করে নিরুদ্দেশের পথে বের হয়ে পড়লেন। একদা বহুমুল্যবান পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা ছিল যার সর্বক্ষনের অভ্যাস, সেই ব্যক্তিই মোটা চট-বস্রে আভ্রু ঢেকে দিনের পর দিন নানা স্হানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
ইমাম গাজ্জালী র: এর এ কৃচ্ছতাপুর্ন তাপস জীবনেরই সর্বাপেক্ষা মুল্যবান ফসল ‘এহইয়াও উলুমুদ্দীন” বা দ্বীনী এলেমের সন্জিবনী সুধা। এই মহা গ্রন্হের প্রভাবেই হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের সুচনাকালে ইসলামের ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য পটপরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। নুরুদ্দীন জঙ্গী,সালাহউদ্দীন আইয়ুবী প্রমুখ ইসলামের বহু বীর সন্তান -যাদের নিয়ে মুসলিম উম্মাহ গর্ব করে থাকে। এরা সবাই ছিলেন ইমাম গাজ্জালী র: এর ভাবশীষ্য,’এহইয়াও উলুমুদ্দীন” এর ভক্ত পাঠক।
,মাদ্রাসা নিযামিয়াতে অবস্হান কালে হযরত ইমাম গাজ্জালী র: মুল্যবান পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করতেন। কিন্তু দেশ পর্যটনের সময় তিনি নিতান্ত সাধারন পোশাকে ও একটি মোটা কম্বল সম্বল করে বের হন। কিন্তু ইহাতেও তাকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। সিরিয়ার পথে তিনি কিছুকাল দামেশক নগরস্হিত উমায়্যা জামে মসজিদে অবস্হান করেন। তৎকলে এই মসজিদের পার্শ্বে একটি ইড়াট মাদ্রাসা ছিল। হযরত ইমাম গাজ্জালী র: এই মসজিদের পশ্চিম পার্শ্বস্হ মিনারের এক প্রকোষ্ঠে স্বীয় বাসস্হান নির্ধারন করেন এবং অধিকাংশ সময়ই ইহাতে মুরাকাবা -মোশাহাদায় নিমগ্ন থাকতেন।
অবসর সময়ে তিনি কিছুসংখ্যক অতি আগ্রহী শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করতেন এবং সময় সময় আলিমগনের সাথে জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনা করতেন।

বায়তুল মাকদাস গমন ও নির্জনবাস অবলম্বন-

দুই বৎসর দামেশক নগরে অবস্হানের পরে তিনি বায়তুল মাকদাসে গমন করেন।তথায় তিনি ‘সাখরাতুসসাম্মা নামক বিখ্যাত প্রস্তরের নিকটবর্তী এক নির্জন প্রকোষ্টে অবস্হান করতে থাকেন। তিনি ইহাতে সর্বদা জিকির আজকারে মশগূল থাকতেন এবং সময় সময় নিকটবর্তী পবিত্র মাজার সমুহ যিয়ারত করতেন।

মকামে খলীলে তিনটি প্রতিজ্ঞা –

বয়তুল মাকদাসের যিয়ারত শেষ করে ‘মকামে খলীল’ নামক স্হানে হযরত ইব্রাহিম আ: মাযার শরীফ যিয়ারত করেন।সেখানে তিনি তিনটি প্রতিজ্ঞা করেন-
১।কখনও কোন রাজ দদরবারে যাব না।
২। কোন বাদশাহর কোন দান বা বৃত্তি গ্রহন করবো না।
৩।কাহারও সঙ্গে বিতর্কে প্রবৃত্ট হব না।
বায়তুল মাকদাসে অবস্হান কালে হযরত ইমাম গাজ্জালী র: অনেক সময় বায়তুল আকসায় আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যনে মগ্ন থাকতেন।

মদিনা শরীফ জিয়ারত –

বায়তুল মাকদাস থেকে হযরত ইমাম গাজ্জালী র: মদীনা শরীফ গমন করে রাসুলুল্লাহ সা: এর রওজা মোবারক জিয়ারত করেন এবং সেখানে কিছুদিন অবস্হান করেন।

হজ্ব সমাপন ও দেশ ভ্রমন –

মদীনা শরীফ হতে তিনি মক্কা শরীফ গমন করে তিনি হজ্ব সমাপন করেন। এখানেও তিনি ধীর্ঘকাল অবস্হান করেন। মক্কা মদীনায় অবস্হানকালে তিনি দুনীয়ার বিভিন্ন দেশের বহু বুজুর্গের সহিত সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা করেন।
অতপর সেখান থেকে তিনি বিশ্ববিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া গমন করেন। সেখানে কিছুকাল অবস্হানের পর দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরিবার পথে তিনি আবার পবিত্র মক্কা-মদীনা যিয়ারত করেন।
বাগদাদ হতে বের হয়ে দীর্ঘ দশ এগার বৎসরকাল তিনি বহু বন-জঙ্গল,জনপথ ও মরুপ্রান্তর পরিভ্রমন করেন। বলাই বাহুল্য তৎকালে যাতায়াতের জন্য বাহন পশু ব্যতীত অন্য কোন উপায় ছিল না। কিন্তু এত কষ্টকর ভ্রমনেও তার ইবাদত-বন্দেগী ও ও রিয়াযত ও মোঝাহাদায় কোন প্রকার ত্রুটি বিচ্যুতি হয়নি। ফলে তার অন্তর-আত্না নির্মল ও পবিত্র হয়ে পড়ে। এবং দিব্যজ্ঞানের
পথে সমস্ত পর্দা একেবারে অপসারিত হয়ে পড়ে।

পুনরায় মাদ্রাসা নিযামিয়ায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান –

হযরত ইমাম গাজ্জালী র: উপলব্ধি করেন যে ,সমগ্র দুনিয়া ধর্মের দিক হতে মোড় ঘুরিয়ে নিচ্ছে এবং মুসলমানগন ধর্ম কর্মে দিন দিন শিথিল হয়ে পড়ছে। জড়বাদী দর্শন -বিজ্ঞানএর ঝড়-ঝন্জার সংঘাতে ধর্মের সুত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ছে। এজন্য নির্জন বাস পরিত্যগ করে ধর্ম প্রচারে আত্ননিয়োগের মনস্হ করেন। বাগদাদ অধিপতি সুলতান মালেক শাহের পুত্র সুলতান সালজানর সালজুকীর প্রধান মন্ত্রী ফখরুল মুলক(ভুত পুর্ব প্রধান মন্ত্রী নিজামুল মুলকের জৈষ্ঠপুত্র) এই সময় আবার হযরত ইমাম গাজ্জালী র:কে মাদ্রাসা নিযামিয়ার অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোঢ করেন। তাহার বন্ধুবান্ধবগনও তাহাকে তাহাকে ইসলামী শিক্ষা প্রসারে আ্তবনিয়োগ করার অনোরোধ জানাতে থাকেন। এতদব্যতিত স্বপ্নযোগেও বহু পবিত্র আত্নার পরামর্শও আসতে থাকে। সুতরাং দেশে প্র‌ত্যাবর্তন করত হিজরি ৪৯৯ সালের যিলকাদ মাসে পুনরায় তিনি মাদ্রাসা নিযামিয়ায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করে যথারীতি ধর্মশিক্ষায় আত্ননিয়োগ করেন।তিনি অতিউৎসাহের সাথে তার এই কার্জ চালিয়ে যেতে লাগলেন।

মাদ্রাসা নিযামিয়া পরিত্যাগ

হিজরী ৫০০সালের মহররম মাসে প্রধান মন্ত্রী ফখরুল মুলক এক দুরাচার গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার অনতিকালেবপরেই হযরত ইমাম গাজ্জালী র: মাদ্রাসা নিযামিয়া পরিত্যগ করেন এবং স্বীয় বাসভবনের অনতিদুরে একটি খানকা প্রতষ্ঠা করে ইলমীদ্বীনের শিক্ষার্থী ও আল্লাহর পথের পথিকদেরকে শিক্সা দিতে থাকেন। বাকী জীবন তিনি এই স্থানে এই কার্জেই নিয়োজিত ছিলেন।

হিংসার কোপে ইমাম সাহেব (র:):-

মাদ্রাসা নিযামিয়ার অধ্যক্ষপদ পুন:গ্রহনের জন্য বাগদাদাধিপতি সুলতান সানজার সুলজুকী ইমাম সাহেব র: কে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু এতে তিনি রাজী হননি। এই সুযোগে হিংসাপরায়ন কিছু লোক তার বিরুদ্ধে সুলতানকে উত্তেজিত করার প্রয়াস পায় । সুলতান হানাফী মাযহাবালম্বী ছিলেন। তারা তার কাছে অভিযোগ করলো যে,’মন্‌খুল’ কিতাবে ইমাম গাযযালী সাহেব হযরত আবূ হানীফাক(র:)-কে তীব্রভাবে আক্রমন করেছেন। এতে ইমাম সাহেবের প্রতি সুলতানের আসন্তোষের উদ্রেক হয়। রাজ দরবারে হাযির হওয়ার জন্য হযরত ইমাম সাহেবের উপর নির্দেশ দেওয়া হয়। তদনুযায়ি তিনি দরবারে উপস্থিত হলে সুলতান দন্ডায়মান হয়ে তাকে আলিঙ্গন করেন এবং তাকে সিংহাসনে বসান । হযরত ইমাম আবূ হানীফা(র:)-র বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন: ”ইহা সত্য নহে। তাহার সম্বন্ধে আমার সেই বিশ্বাসই বলবৎ আছে,যাহা আমি ‘ইয়াহইয়াউল উলূম’ কিতাবে প্রকাশ করিয়াছি । তাহাকে আমি ফিকাহশাস্ত্র যুগস্রষ্টা ইমাম বলিয়া স্বীকার করি ।” এতে সুলতানের ধারনা সম্পূর্নরুপে পরিবর্তিত হলো ।

নিযামিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদ পুন:গ্রহনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান :-

হযরত ইমাম গাযযালী র: মাদ্রাসা নিযামিয়া পরিত্যাগ করার পর এর যশ:গৈ*রব হ্রাস পায়। ইহা পুনরুদ্ধারের জন্য আমীর-উমরাহ ও রাজপুরুষগন নানা উপায়ে তাকে এর অধ্যক্ষ পদে পুন:অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে থাকেন । সালজুকী সুলতান এবং খলীফার দরবার হতেও তার কাছে বারবার অনুরোধপত্র আসতে থাকে । কিন্তু নিম্নলিখিত কারনে তিনি তা গ্রহনে অসন্মতি জানান:-

১, তুসনগরে বর্তমানে আমার কাছে দেড়শত ছাত্র অধ্যয়নরত আছে। আমি বাগদাদে চলে গেলে তাদের
পক্ষে সেখানে যাওয়া দু:সাধ্য হবে।
২, পূর্বে আমার কোন সন্তান ছিল না । কিন্তু এখন আল্লাহ তা’আলা কয়েকটি সন্তান দান করেছেন । তাদেরকে
ছেড়ে বাগদাদে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।
৩, মাকামে খলিলে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, ভবিষ্যতে আর কোন বিতর্কে প্রবৃত্ত হব না । কিন্তু বাগদাদে ইহা হতে
অব্যাহতির উপায় নেই ।
৪, খলিফার সন্মানার্থে তার দরবারে উপস্থিত হতে হবে । আমার এটা বরদাস্ত হবে না ।
৫, রাজদরবার হতে কোন বেতন বা, বৃত্তি গ্রহন করবোনা বলে প্রতিজ্ঞা করেছি । বাগদাদে আমার কোন সমপত্তি নেই। সুতরাং, কিভাবে আমি বাগদাদে অবস্থান করবো ?

মোটকথা সর্বপ্রকার অনুরোধ সত্তেও তিনি উক্ত অধ্যক্ষ পদ গ্রহণে আর সন্মত হননি । জীবনের অবশিষ্ট সময় তিনি তুস নগরেই অতিবাহিত করেন গ্রন্থ রচনায় ইমাম গাজ্জালী র: –

জ্ঞানের আলো বিতরনের উদ্দেশ্যে হযরত ইমাম গাজ্জালী র: এর এ পৃথিবীতে আবির্ভাব। বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা নিঃসন্ধেহে অতুলনীয়। এ মনীষি মাত্র ৫৫ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। শৈশব ও পাঠ্য জীবন বাদ দিলে মাত্র ৩৪/৩৫ বৎসর কর্মজীবনে তিনি প্রায় চার শত অমুল্য গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে ”ইয়াকুতুততাবলিক” নামক তাফসীর ৫০ খন্ডে বিভক্ত এবং ”ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” বিড়াট চার খন্ডে সমাপ্ত। প্রত্যেকটি খন্ডও আবার দশটি পৃথক বিভক্ত। ১০/১১ বৎসর তিনি আবার দেশ পর্যটন ও নির্জনবাসে অতিবাহিত করেন। তদুপরি অধ্যাপনা, অধ্যায়ন, ধ্যন-সাধনা ও এবাদৎ বন্দাগীতেও কিছু সময় ব্যয় হতো। তার দরবারে শিক্ষার্থী ও দীক্ষা প্রার্থীদের সংখ্যা কোন দিনই দেড়শত এর কম হতো না। তাছারাও দুরদুরান্ত হতে নানা জটিল বিষয়ে ফতোয়ার জন্য অনেকলোক তার দরবারে আগমন করতো এবং ওয়াজনসিহত ও বিতর্কসভাও তাকে করতে হতো। উহাতেও তার কম সময় ব্যয় হতো না। এতসব কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি এত গুলি গ্রন্থ রচনা করে তিনি অসাধারন প্রতিভারই পরিচয় দিয়েছেন।
আল্লামা নববী বলেন ,ইমাম গাজ্জালী র: এর সম্পুর্ন আয়ুষ্কাল (জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত) ও তার রচিত গ্রন্থাবলীর হিসাব আন্তে আমি গড় করে দেখেছি, তিনি গড়ে প্রত্যেকদিন ১৬ পৃষ্ঠা লিখেছেন।
দর্শন,তর্ক,ইলমে কালাম, ধর্মতত্ব,মনস্তত্ত্ব,স্বভাব-বিজ্ঞান,নীতি-বিজ্ঞান, আধ্যাতিক তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

ফিকাহ- ওয়াসীত,বাসীত,ওয়াজীয,বয়ানুল কাওলায়নিলিশ শাফীঈ তা’লীকাতুন ফি-ফুরুইল মযহাব, খোলাসাতুর রাসাইল, ইখতিসারুল, মুখতাসার, গায়াতুল গাওর, মজমুআতুল ফতাওয়া ।

ফিকাহ শাস্ত্রের মুলনীতি-

তাহসিনুল মাখাজ, সিফাউল আলীল, মুন্তাখাল ফি ইলমিল জিদল, মনখুল, মুসতাসফা, মাখায় ফিল খিলাফিয়াত, মোফাসসালুল খিলফি ফি উসুলিল কিয়াস।
মানতিকঃ মিয়ারুল ইলম,মীযানুল,আ’মল (ইউরোপে প্রাপ্তব্য)

দর্শন- মাকাসিদুল ফালাসিফাহ, তাহাফুতুল ফালাসিফাহ (ইউরোপে সংরক্ষিত)।

ইলমি কালাম- আহাতাফুল ফালাসিফাহ,মুনকিয ,ইলজামুল আওয়াম ইকতিসাদু,মসতাযহারী ফাযাইহুল ইবাহিয়্যাহ হাকিকাতুর রুহ,কিসতাসুল মুসতাকিম,কাওলুল জমিল ফি রাদ্দিন আলামান গায়্যারাল ইন্জিল, মাওয়াহিবুল বাতিনিয়্যাহ, তাফাররাকাতুম বায়নাল ইসলামি ওয়াল জিন্দিকাহ, আর রিসাতুল কুদসিয়াহ।
আধ্যাত্নিক ও নৈতিক বিষয়- ইয়াহইয়াওমুল উলুম, কিমিয়ায়ে সাআদাত, আল মাকসুদুল আকসা,আখলাকুল আবরার,জওয়াহিরুল কুরআন, জওয়াহিরুলকুদসি ফী হাকীকাতিন্নাফস, মিশকাতুল আনওয়ার, মিনহাজুল আবেদীন, মিরাজুস সালিকীন, নাসীহাতুল মূলক, আয়্যুহাল ওলাদ, হিদায়াতুল হিদায়াহ,মিশকাতুল আনওয়ার ,ফী লাতাইফিল আখয়ার।
নিশাপুর অবস্হানকালে ,ইমাম গাজ্জালী র: গ্রন্হাদি রচনা শুরু করেন। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের যে জড়বাদ বিশেষত গ্রীক দার্শনিকদের ভ্রান্ত মতবাদ মুসলমানদের ধর্ম-বিশ্বাসে প্রবেশ করেছিল। এ সময়েই তিনি অতিসুন্দর ও সুক্ষ যুক্তিপুর্ন বিচারে ‘মনখুল’(চালনি দ্বারা চালা) নামক গ্রন্হ রচনা করে এইসব দোস ত্রুটির মুলুৎপাটন করার প্রয়াস পান।প্রথম জীবনের লেখা হলেও ইহা সুধী উচ্চপ্রশংসা অর্জন করে। এমনকি তাহার উস্তাদ হযরত ইমানুল হারামাইন স্বয়ং এই গ্রন্হ পাঠে মন্তব্য করেন  “জীবতাবস্থায়ই তুমি সমাধিস্ত করিলে। ” অর্থাৎ ছাত্রের খ্যাতি উস্তাদের জীবদ্দশায়ই তার খ্যাতিকে অতিক্রম করে গেল।
ইমাম গাজ্জালী র: এর রচিত ”ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” গ্রন্হখানি ইসলাম জগতে বিশেষ সমাদৃত। সুধীগন ইহার উচ্চ প্রশংসা করেছেন। এ সম্পর্কে শীর্ষস্থানীয় কতিপয় মনীষীর উক্তি হল, ”জগতের সমস্ত জ্ঞান প্রদীপ নির্বাপিত করে দিলে কেবল ”ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” দ্বারাই উহা পুনরুদ্ধার করা যাবে। “ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” এর পুর্ব এরুপ গ্রন্হ জগতে আর লিখিত হয়নি।” ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” কোরান শরীফের নিকটবর্তী গ্রন্থ।”জগদ্বিখ্যাত সিদ্ধপুরুষ হযরত গাজজালী র: একদা এক বিরাট জনতাকে সম্বোধন করে বললেন : আমার হাতে কোন গ্রন্থ তোমরা জান কি? ইহা ”ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন”। গ্রন্থখানিকে অবজ্ঞা করার কারনে আমার বিরুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে অভিযোগ করা হয়। স্বপ্নযোগে দেখলাম,বিচারে আমার পৃষ্ঠে চাবুক মারা হয়েছে। এই দেখ,আমার পৃষ্ঠে চাবুকের চিহ্ন বিদ্যমান ।

তাঁর রচিত ‘মাকাসিদুল-ফালাসিফা’, ‘তাহাফুতুল-ফালাসিফা’ প্রভৃতি দর্শন শাস্ত্রের কিতাব সমগ্র ইউরোপে সমাদৃত হয়েছে এবং ইংরেজি,ফারসী,ল্যাটিন,হিব্রু ইত্যাদি ভাষায় এগুলোর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এই সকল গ্রন্থ ইউরোপীয় বহু বক্রপন্থী পন্ডিতের জ্ঞানচক্ষু প্রস্ফুটিত করে দিয়েছে।জনৈক ইউরোপীয় পন্ডিত বলেছেন, ইমাম গাজ্জালী র: ও ইবনে রুশদের জন্ম না হলে মোসলমানগন নিউটন ও এরিষ্টটলের জাতি হয়েই থাকতো। বস্তুত পাশ্চাত্যের জড়বাদী ভ্রান্ত দার্শনিক মতবাদের মোকাবিলায় খটি দর্শনকে বলিষ্ঠ যুক্তিতে প্রকাশ করে ইমাম গাজ্জালী র: বিশ্ব মানবের মুল্যবোধ ও চিন্তাধারায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করেন। বিশেষত আধ্যাতিক জ্ঞান ও চিন্তাধারাকে সঠিক পথের সন্দ্ধান দিয়ে তি মানব ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।
মুসলিম বিশ্ব অপেক্ষা খৃষ্টান ইউরোপেই ইমাম গাজ্জালী র: এর গ্রন্হাবলী সমাদৃত বেশি। প্রখ্যত কবি দান্তে,মনিষী রেমন্ড মার্টিন,মনীষী সেন্ট টমাস একুইনাস,প্রখ্যাত ফরাসি মিসটিক ব্লেইসি প্যাসকেল ইমাম গাজ্জালী র: এর গ্রন্হরাজি হতেই তাদএর যুক্তি ও উদাহরন গ্রহন করেন এবং তার মতামতকেই প্রামান্য বলেই উল্লেখ করেন। তার ৪০ টি গ্রন্হ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত ও প্রকাশিত হয়।
”কিমিয়ায়া সাদাত” ইমাম গাজ্জালী র: এর অপর একখানি অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রস্থ। দুনিয়ার প্রায় সকল ভাষায় এই মুল্যবান গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।বার্ন শহরে লেটিন ভাষায় ইহা সর্বপ্রথম অনুদিত হয় এবং অধ্যাপক হিথজীন ইহার কঠিন শব্দসমুহের ভাষ্য রচনা করেন।

শোকের ছায়া-

সোমবার মাহে জামাদাল উখরা,হিজরী ৫০৫ সাল মোতাবেক ১৯ শে ডিসেম্বর ১১১১ খ্রীষ্টাব্দ। ফজরের নামাজ সমাপনান্তে সমগ্র বিশ্বের বিশ্বয়কর প্রতিভা, যুক্তি ও যুক্তিবাদী অপ্রতিদন্দ্বী দার্শনিক, বিশ্ব মানবতার দিশারী, সুফীকুল শিরমনি হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম আবু হামিদ মুহম্মদ গাজ্জালী র: মাত্র ৫৫ বৎসর বয়সে দুনিয়াবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরমকরুনাময় আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে হাজির হন। সম্পুর্ন সুস্থদেহেই তিনি ইন্তেকাল করেন। তাহার তিরোধান সম্পর্কে তার ভ্রাতা হযরত ইমাম আহমদ র: বলেন, সোমবার দিন অতিপ্রত্যুষে শয্যাত্যাগ করে তিনি স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাস অনুসারে অজু করে ফজরের নামাজ আদায় করেন। তৎপর পুর্বপ্রস্তুত করা তার কাফনটি চেয়ে নেন এবং ইহা চোখে স্পর্শ করে বললেন,প্রভুর আদেশ শিরধার্য। কথাটি মোখ হতে নিঃসৃত হওয়ার সাথে সাথে তিনি স্বিয় পদদ্বয় প্রসারিত করলেন এবং সেই মুহুর্তেই ইহজগত ত্যাগ করলেন। পরম করুনাময় আল্লাহ পাক তাকে ইহজগত পর জগতে যথাযোগ্য মর্যাদা দান করুন, আমিন।

আপনার পছন্দের আর পোস্ট
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now

Post a Comment

Assalamu Alaikum Wa Rahmatullah
Greetings!
Provide your feedback.