মন্দার মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতি
(toc)
করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় গতি হারায় পুরো বিশ্বের অর্থনীতি। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ বিশ্বব্যাংকের 'বিশ্বে "কি মন্দা আসন্ন' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির তিন মূল চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের অর্থনীতি দ্রুত গতি হারাচ্ছে। ফলে আগামী বছরে সামান্য আঘাতেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ১৯৮০-এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত ৯ বার মন্দার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। এর মধ্যে মাত্র পাঁচবার মন্দা দেখা গেছে।
মন্দা কী?
মন্দার কোনো স্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। অর্থনীতির ভাষায় - সাধারণত একটি অর্থবছরের পরপর দুইটি প্রান্তিকে কোনো দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে যদি নিম্নমুখী বা ঋণাত্মক ধারা অব্যাহত থাকে তবে তাকে মন্দা বলা হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে অর্থনীতির বিকাশ যখন ৩ শতাংশের কম হয় তখন সেই পরিস্থিতিকে বিশ্বব্যাপী মন্দা বলা যায়। তাদের হিসাবে আনুমানিক ৮-১০ বছর পরপর চত্রকারে বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দেয়।
প্রকারভেদ
অর্থনীতিবিদরা মন্দাকে V-Shape, U-Shape, L- Shape কিংবা W-Shape হিসেবে অর্থনীতির সূচকের গ্রাফে ব্যাখ্যা করে থাকেন। অর্থনীতির গ্রাফে সূচকগুলো ওঠানামার আকৃতি V-Shape হলে বোঝতে হবে মন্দা ক্ষণস্থায়ী, আর U-Shape হলে মন্দা দীর্ঘস্থায়ী। মন্দা উপর্যুপরি হলে এর সূচকের ওঠানামা গ্রাফে দেখাবে W এর মতো। আবার ১৯৯৭- ১৯৯৯ সালে জাপানের পরপর নয়টি প্রান্তিকের মধ্যে আটটি প্রান্তিকের গ্রাফ চিত্রে মন্দা দৃশ্যমান হয় L-Shape হিসেবে।
কারণ
যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট আকস্মিক অর্থনৈতিক ধাক্কা থেকে শুরু নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে মন্দার উদ্ভব হতে পারে। আকস্মিক অর্থনৈতিক ধাক্কার কারণেও অতীতে মন্দা হতে দেখা গেছে। ৭০ এর দশকে ওপেক যুক্তরাষ্ট্রকে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে কোনো ধরনের সতর্কবার্তা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। সাম্প্রতিক করোনা - ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বেই অর্থনীতি কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। এটাকেও আকস্মিক অর্থনৈতিক আঘাত হিসেবে দেখা হয়।
ব্যালেন্স শিট রিসিশন বা খাতা-কলমের মন্দা : সাধারণত কোনো রাষ্ট্রের অত্যধিক ঋণগ্রস্ততা অথবা আর্থিক খাতের পতনের ফলে একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষকে একইসঙ্গে ঋণ পরিশোধ করতে হলে এ ধরনের মন্দা ঘটে। আবার কোনো দেশ যদি সাধ্যের অতিরিক্ত ঋণ নিয়ে থাকে যা এক পর্যায়ে তাদের শোধ করা সাধ্যের বাইরে চলে যায় তখনও মন্দা দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি : মূল্যস্ফীতি যখন অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় চলে যায় তখন বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দেয় এদিকে আবার উচ্চ সুদের হার তখন দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। ৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
ইতিহাস
আধুনিক অর্থব্যবস্থায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্রথম মন্দা দেখা দেয়। আবার বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এর ব্যাপ্তি ছিল ১৯২৯-১৯৩৯ সাল পর্যন্ত। ১৯২৯ সালে অক্টোবরে মাত্র দুই দিনে ধ্বংস হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার। কয়েক দিনের মধ্যে শিল্প কলকারখানায় উৎপাদনে ধস নামে। মাত্র এক বছরের মাথায় বেকার হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের এক কোটি মানুষ । ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। ১৯৯৭ সালে বিদেশি মুদ্রার অভাবে এশিয়ার বাজারে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এ সময় থাইল্যান্ড থেকে কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে থাকেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। থাইল্যান্ড থেকে শুরু হওয়া এ অর্থ সংকট দ্রুত পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়লে দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রধান কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গৃহায়ণ খাতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। দেশটির বন্ধকি বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণব্যবস্থা ও আর্থিক খাতের শিখিল নিয়ন্ত্রণই মন্দার শুরুটা করেছিল।
দ্য গ্রেট ইনফ্লেশন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমৃদ্ধি এনে দেয়। সে সময় উৎপাদন বাড়ে কমে যায় বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতিও ছিল প্রায় ১%। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় ১৯৬৫ সাল থেকে। বাড়তে থাকে বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি। এ পরিস্থিতি ছিল ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। ১৯৮০ সালে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১৫%। এ সময়কেই বলা হয় দ্য গ্রেট ইনফ্লেশন। এর মধ্যেই অভিজ্ঞতা হয় স্ট্যাগরেশনেরও। ১৯৮১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন রোনাল্ড রিগ্যান। সে সময়ের মূল্যস্ফীতি দেখে তিনি একটি বিখ্যাত উক্তি করেন। উক্তিটি হলো 'মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ছিনতাইকারীর মতো হিংস্র, সশস্ত্র ডাকাতের মতো ভয়ংকর এবং খুনির মতোই প্রাণঘাতী।'
বাংলাদেশের করণীয় ও চ্যালেঞ্জ
আসন্ন মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। মন্দায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে তার সাথে দেশের বাজারের সমন্বয় সাধন করতে হবে। বাংলাদেশের সামনে কয়েকটি বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসবে। এগুলো হলো— রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে, আমদানি করা খাদ্য পণ্যের দাম বাড়বে ও রেমিট্যান্স কমতে পারে।