জন্ম:
শহীদ নুরুল ইসলাম ফারুকী ২৪ নভেম্বর ১৯৫৯ সালে পঞ্চগড় জেলার বড়শশী ইউনিয়নের নাউতারী নবাবগঞ্জ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জামসেদ আলী ছিলেন একজন গুনি আলেম। তিনি এমন একজন সুন্নিয়াতের বীর সৈনিক ছিলেন। যিনি লাখো কোটি সুন্নি মুসলমানদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।
আল্লামা নুরুল ইসলাম ফারুকী (রা:) সারা দেশে ওয়াজ মাহফিল করতেন, সুন্নিয়াতের খেদমত করতেন। সুন্নিয়াতের পক্ষে যুক্তিযুক্ত প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করতেন। তার মতো সাহসী কথা বলার মতো আলেম সুন্নিদের মধ্যে খুবই কম ছিলো।
আল্লামা নুরুল ইসলাম ফারুকী (রা:) মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে সত্য-মিথ্যা দেখিয়ে দিয়ে ছিলেন। তিনি জনসম্মুখে ইয়াজিদি ইসলাম ও হোসাইনি ইসলামের পরিচয় তুলে ধরতেন। এজন্যই এজিদের অনুসারীরা তাঁকে দেখতে পারত না। তিনি মাহফিলে একটা কথা বলতেন, ইসলাম দু’ভাগে বিভক্ত- একটা হোসাইনি ইসলাম আরেকটা ইয়াজিদি ইসলাম। তিনি দুই মেয়ে ও চার ছেলেসহ অসংখ্য ভক্তবৃন্দ রেখে যান।
শিক্ষাজীবন:
শহীদ আল্লামা শায়খ নুরুল ইসলাম ফারুকী তাঁর নিজ গ্রামে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালে নীলফামারী জেলার ডোমার থানার অন্তর্গত চিলাহাটি জামিউল উলুম সিনিয়র মাদরাসা থেকে দাখিল পরবর্তীতে একই মাদরাসা থেকে আলিম পাস করেন। ১৯৭৯ সালে প্রাচীনতম ঐতিহাসিক ছারছীনা দারুসসুন্নাত কামিল মাদরাসা থেকে আলিম ও কামিল (হাদিস বিভাগ) ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৮১ সালে নীলফামারী সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে জগন্নাথ কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে স্নাতক করেন। তাঁর জ্ঞান ও মেধার প্রখরতা এমন ছিল যে তিনি ছাত্র জীবন থেকে লেখা-লেখি, বক্তৃতা এবং কোরআন তেলাওয়াতে প্রথম স্থান অধিকার করতেন।
দায়িত্ব পালন:
তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রথমে পুরান ঢাকার রায়সাহেবের বাজার জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার কিছুদিন পর ঢাকা কেরানীগঞ্জের নূরানীয়া চিশতীয়া আলীয়া মাদরাসার প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৮৯ সালে প্রথম হজ গমনের উদ্দেশে মক্কায় যান। সে বছর জেদ্দা বিমানবন্দর মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান।
শহীদ নুরুল ইসলাম ফারুকী মক্কা মোয়াজ্জামায় আল্লামা সায়েদ মোহাম্মদ মালিকি আলাদি (রা:) রওজায় ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। এসময় ঢাকাসহ বিভিন্ন মসজিদে ৩৩ বছর ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। আবার ছারছীনা পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ (রা:) মাজারে খেদমত করেন।
সর্বশেষ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত খাজা হযরত শরফুদ্দিন চিশতি (রা:) এর মাজারে খাদেম ও সুপ্রিমকোর্ট জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আরো জানা যায়, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী ইসলামী মিডিয়া জনকল্যাণ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন। পূর্ব রাজাবাজার জামে মসজিদের সেক্রেটারি দায়িত্ব পালন করেন এবং মেঘনা ট্রাভেলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন।
জনপ্রিয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব:
চ্যানেল আইয়ের ইসলামিক অনুষ্ঠান ‘কাফেলা’ ও ‘শান্তির পথ’র অনুষ্ঠানের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই অনুষ্ঠানের মধ্যমে তিনি বাংলাদেশসহ বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষের নিকট বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। এ অনুষ্ঠানটির জন্য তিনি মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে ভ্রমণ করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন আলীয়া মাদরাসায় ১৫ বছর শিক্ষকতা, রেডিও, টেলিভিশনে ২৫ বছর ওয়াজ নসিহত ও বিভিন্ন ইসলামীক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। বাংলাদেশের মানুষের সুন্দর ও সঠিক নিয়মে পবিত্র হজ পালনে ২৫ বছর হজ কার্যক্রম চালিয়েছেন।
সফর:
তিনি কাফেলা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বহু দেশ ভ্রমন করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হচ্ছে- আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ভারত, শ্রীলঙ্কা, জর্ডান, তুরস্ক, ইতালি, ইরান, মিশর ইত্যাদি বহু বার ভ্রমন করেছেন।
প্রকাশনা:
তিনি কয়েকটি বই লিখেছেন। তার বইগুলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আক্বায়েদে সুফিবাদ ভিত্তিক। সর্বশেষে ‘মারেফুল হারামাইন’ বইটি লিখেছেন। বইগুলোতে ইসলামের স্থাপত্য বা অবিক্রিত রূপগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়েছে।
ওফাত:
২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর ১৭৪, পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাসায় দুর্বৃত্তর পরিচয়ে ইসলামী চরমপন্থিরা তাকে গলাকেটে হত্যা করে। তাঁর ছেলে আহমেদ রেজা ফারুকী বলেন, রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁর বড় ভাই ফয়সাল দরজা খোলা পেয়ে বাসায় ঢুকে প্রথমে বসার ঘরে থাকা তাঁর ভাই মারুফের বাঁধন খুলে দেন। পরে খাবার ঘরে গিয়ে বাবাকে গলা কাটা ও নিথর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। খুবই নৃশ:স্যভাবে হত্যা করে ঘাতকেরা। যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। আল্লাহ্ তার শাহাদাতকে কবুল করুন। (আমিন)
তাঁর নামাযে জানাযায় লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশ গ্রহণ করে। পরে তাকে তাঁর নিজে গ্রামে (পঞ্চগড়) বাবা ও মা’র পাশে শায়িত করা হয়। প্রতিদিন তাঁর মাজার জিয়ারত করার জন্য অনেক মানুষ তার সমাধীস্থলে উপস্থিত হয়। প্রতি বৎসর তাঁর ওফাত বার্ষিকী সারা দেশে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন পালন করে থাকে।