Table of Contents
(১) পার্থিব প্রয়োজনে দাঁড়ানো জায়েয। এর হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে। যেমন :- দাঁড়িয়ে দালান তৈরী করা এবং অন্যান্য দুনিয়াবী কাজকর্ম ইত্যাদি করা। কুরআন মাজীদে উল্লেখিত আছে-
فَاِذَا قَصِيتِ الصَّلوةُ فَانْتَشِرُوْا فِى الْاَرْضِ
(যখন জুমআর নামায হয়ে যাবে, তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়) না দাঁড়িয়ে ছড়িয়ে পড়া কখনও সম্ভব নয়।
(২) পাঁচ ওয়াক্তিয়া ও ওয়াজিব নামাযে দাঁড়ানো ফরয। যেমন- وَقُوْموْا لِلهِ قنِتِيْنَ আল্লাহর সামনে আনুগত্য প্রকাশ করত: দন্ডয়মান হও। অর্থাৎ যদি কোন লোক সামর্থ থাকা সত্তেও বসে আদায় করে, তাহলে নামায হবে না।
(৩) নফল নামাযে দন্ডায়মান হওয়া মুস্তাহাব। অবশ্য বসেও জায়েয। তবে দাঁড়িয়ে পড়াতে ছওয়াব বেশী।
(৪) কয়েকটি বিশেষ সময় দাঁড়ানো সুন্নাত-
প্রথমতঃ ধর্মীয় মর্যাদাশীল জিনিসের সম্মানার্থে দাঁড়ানো। এ জন্য যমযমের পানি ও ওযুর অবশিষ্ট পানি দাঁড়িয়ে পান করা সুন্নাত। হুযুর আলাইহিস সালামের রওযা পাকে উপস্থিত হওয়া যদি আল্লাহ নসীব করেন, তখন নামাযের মত হাত বেঁধে দাড়ানো সুন্নাত। ফাতওয়ায়ে আলমগীরীর প্রথম খন্ডে কিতাবুল হজ্জের শেষে- زيارت قبر النبى عليه السلام শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখ আছে-
وَيَقِفُ كَمَا يَقِفُ فِى الصَّلوةِ وَيُمَثِّلُ صُوْرَتَهُ الْكَرِيْمَةَ كَاَنَّهُ نَائِم فِىْ لَحْدِه عَالِم بِه يَسْمَعُ كَلَامَهُ
পবিত্র রওযা শরীফের সামনে এমনভাবে দাড়াবে যেভাবে নামাযে দাঁড়ানো হয় এবং সেই পবিত্র চিত্র মনের মধ্যে এমনভাবে স্থাপন করবে, যাতে মনে হয় হুযুর আলাইহিস সালাম রওযা পাকে আরাম ফরমাচ্ছেন, তাকে চিনছেন ও তার কথা শুনতেছেন।
অনুরূপ মুমিনের কবরে ফাতিহা পাঠ করার সময় কেবলার দিকে পিঠ এবং কবরের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো সুন্নাত। আলমগীরী কিতাবুল কারাহিয়ার زيارت القبور অধ্যায়ে আছে-
يَخْلَعُ نَعْلَيْهِ ثُمَّ يَقِفُ مُسْتدبِرَ القِدْلَة مَستَقبِلًا لِوَجْه الْمَيَّتِ
প্রথমে জুতা খুলে ফেলুন। অত:পর কাবার দিকে পিঠ করে এবং কবরবাসির দিকে মুখ করে দাঁড়ান। রওযা পাক, যমযম ও ওযুর পানি, মুমিনের কবর সবই পবিত্র জিনিস। কিয়ামের দ্বারা এগুলোর তাযীম করানো হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ যখন কোন ধর্মীয় নেতা আসেন, তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে যাওয়া সুন্নাত। অনরূপ কোন ধর্মীয় নেতা সামনে দাঁড়ালে তার জন্য দাড়িয়ে থাকা সুন্নাত। কিন্তু বসে থাকা বেআদবী। মিশকাত শরীফের প্রথম খন্ডে কিতাবুল জিহাদে – القيام ও حكم الاسر اء শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে যে- যখন হযরত সাআদ ইবনে মুআয (রা:) মসজিদে নববীতে উপস্থিত হন, তখন হুযুর আলাইহিস সালাম আনসারদেরকে হুকুম দিলেন- قُوْمُوْا اِلى سَيِّدِكم আপনাদের নেতার জন্য দাঁড়িয়ে যান। এ দাড়ানো ছিল সম্মানবোধক। তাদেরকে বাধ্য করে দাঁড় করানো হয়নি। অধিকন্তু ঘোড়া থেকে নামানোর জন্য ২/১ জন্যই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সবাইকে কেন বললেন যে দাঁড়িয়ে যাও। আর ঘোড়া থেকে নামানোর জন্য মজলিসে আগতদের মধ্যে থেকে কাউকে ডাকা যেত। কিন্তু নির্দিষ্ট করে আনসারদেরকে কেন হুকুম করলেন? স্বীকার করতেই হবে যে, এ কিয়ামটা ছিল সম্মান বোধক। হযরত সাআদ আনসারদের নেতা ছিলেন। তাই তাদের দ্বারা তাযীম করানো হয়েছে। যাঁরা উপরোক্ত বাক্য ব্যবহৃত الىশব্দ দ্বারা ধোঁকা দিয়ে বলেন যে এ দাঁড়ানোটা ছিল রোগীর সাহায্যার্থে, তারা তাহলে এ আয়াতে কি বলনে- اِذَاقُمْتُمْ اِلى الصَّلوةِ (যখন আপনারা নামাযের জন্য দাঁড়াবেন।)
নামাযও কি তাহলে রোগী যে এর সাহায্যার্থে দাঁড়াতে হয়?
আশআতুল লুমআত গ্রন্থে উপরোক্ত হাদীছ প্রসংগে বর্ণিত আছে-
এখানে হযরত সাআদের প্রতি তাযীম করানোর রহস্য হচ্ছে যে তাঁকে বনি কুরায়জার উপর শাসন করার জন্য ডাকা হয়েছিল। তাই এ জায়গায় তার শান-মান প্রকাশের সঠিক সময় ও প্রয়োজন ছিল। মিশকাত শরীফের القيام অধ্যায়ে হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে-
فَاِذَاقامَ قُمنَا قِيَامًا حَتّى نَرَاه قدْ دَخَلَ بَعْضَ بُيُوْتِ اَزْوَاجِه
যখন হুযুর আলাইহিস সালাম বৈঠক থেকে উঠতেন, তখন আমরা দাড়িয়ে যেতাম এবং এতটুকু পর্যন্ত দেখতাম যে তিনি তাঁর কোন পবিত্র বিবির ঘরে প্রবেশ করছেন। আশআতুল লুমআত কিতাবুল আদাবের কিয়াম শীর্ষক অধ্যায়ে- قوْمُوْا اِلى سَيِّدِ كُمْ এর ব্যাখ্যা প্রসংগে উল্লেখিত আছে-
এ হাদীছের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম পুণ্যাত্মা উলামায়ে কিরামের তাযীম করার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষন করেন। ইমাম নববী বলেন যে বুযুর্গানে কিরামের তাশরীফ আনয়নের সময় দাঁড়ানো মুস্তাহাব। এর সমর্থনে অনেক হাদীছ রয়েছে কিন্তু এর নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে সুষ্পষ্ট কোন হাদীছ নেই। ‘কীনা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে যে আগমনকারী কারো সম্মানার্থে বসে থাকা লোকের দাঁড়িয়ে যাওয়া মাকরূহ নয়। ফতওয়ায়ে আলমগীরী কিতাবুল কারাহিয়ার ملاقات الملوك শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
تُجُوْزُ الْخِدْمَةُ بِغَيْرِ اللهِ تَعَالى بِالْقِيَامِ وَاَخَذِ الْيَدَيْنِ وَالْاِنْحِنَاءِ
খোদা ভিন্ন অন্য কাউকে দাড়িয়ে, করমর্দন করে বা নত হয়ে সম্মান করা জায়েয।
এখানে নত হওয়া বলতে রুকু থেকে কম নত হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। কেননা রুকু পর্যন্ত নত হওয়াতো নাজায়েয। এ প্রসংগে আমি ভূমিকায় আলোকপাত করেছি। দুররূল মুখতার গ্রন্থের প্রঞ্চম খন্ড কিতাবুল কারাহিয়ার الاستبراء অধ্যায়ের শেষে বর্ণিত আছ-
يَجُوْزَ بَلْ يُنْدَبُ الْقِيَامُ تَعْظِيْمًالِلْقَادِمِ يَجُوْزُ الْقِيَامُ وَلَوْلِلْقَارِىْ بَيْنَ يَدَىِ الْعَالِمِ
আগমনকারী কারো সম্মানার্থে দাড়াঁনো জায়েয বরং মুস্তাহাব যেমন আলিমের সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়া কুরআন তিলওয়াতকারীর জন্য জায়েয।
এ থেকে বোঝা গেল যে, কারো কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায় কোন ধর্মীয় আলিম আসলে তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাওয়া মুস্তাহাব। এ প্রসংগে ফতওয়ায়ে শামীতে বলা হয়েছে-
وَقِيَامُ قَارِىُ الْقُرْانِ لِمَنْ يَجْى تَعْظِيْمًا لَا يَكْرَهُ اِذْ كَانَ مِمَّنْ يَسْتَحِقَّ التعْظِيْمَ
কুরআন তিলাওয়াত অবস্থায় আগমকারী কারো সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাওয়া মকরূহ নয়, যদি তিনি সম্মান পাওয়ার উপযোগী হন।
ফতওয়ায়ে শামী প্রথম খন্ড ا لامامت শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে, যদি কেউ মসজিদের প্রথম কাতারে জামাতের অপেক্ষায় বসে আছেন। ইত্যবসরে কোন আলিম আসলে তাকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে নিজে পিছনে চলে যাওয়া মুস্তাহাব। বরং এর জন্য প্রথম কাতারে নামায পড়া থেকে এটা আফযল। এটাতো উলামায়ে উম্মতের তাযীমের জন্য, কিন্তু হযরত সিদ্দীক আকবর (রা:) তো নামায পড়ানো অবস্থায় হুযুর আলাইহিস সালামকে তাশরীফ আনতে দেখে নিজে মুক্তাদী হয়ে গেলেন এবং নামাযের মাঝামাঝি হুযুর আলাইহিস সালাম ইমাম হলেন। (মিশকাত শরীফের مرض النبىঅধ্যায় দ্রষ্টব্য) উপরোক্ত বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে ইবাদতরত অবস্থায়ও বুযুর্গানে দ্বীনের তাযীম করা যায়েয, মুসলিম শরীফের দ্বিতীয় খন্ডে حديث توبه ابن مالك অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-
فَقَامَ طَلْحَةُ اِبْنِ عُبَيْدِاللهِ بُهَرْولُ حَتّى صَافَحَنِىْ وَهَنَّانِىْ
অতঃপর তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ দাঁড়িয়ে গেলেন এবং দৌড়ে এসে আমার সাথে মুসাফাহা করলেন এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন।
এর প্রেক্ষাপটে নববীতে উল্লেখিত আছে-
فِيْهِ اِسْتِحْبَابُ مَصَافَحَةِ الْقَادِمِ وَالْقِيْامِ لَهُ اِكْرَامًا وَالْهَرْوَ لَةِ اِلَى لِقَاءِ
এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে আগমনকারীর সাথে সুসাফাহা করা, এর সম্মানে দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং দৌড়ে এর কাছে আসা মুস্তাহাব।
তৃতীয়তঃ যখন নিজের কোন প্রিয়জন আসে, তখন এর আগমনের আনন্দে দাঁড়িয়ে যাওয়া, হাত পা ইত্যাদি চুমু দেয়া সুন্নাত। মিশকাত শরীফের কিতাবুল আদব المصافحة শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (রা:) মুস্তাফা আলাইহিস সালামের পবিত্র দরজার সামনে আসলেন এবং দরজার কড়া নাড়লেন।
فَقَامَ اِلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَرْيَانًا فَاَعْتَنَقَهُ وَقَبَّلهُ
হুযুর আলাইহিস সালাম চাদর বিহীন অবস্থায় তাঁর প্রতি দাঁড়িয়ে গেলেন। অত:পর কোলাকুলি করলেন এবং চুমু খেলেন।
একই অধ্যায়ে আরও বর্ণিত আছে যে যখনই হযরত খাতুনে জান্নাত ফাতিমা যুহরা (রা:) হুযুর আলাইহিস সালামের সমীপে হাযির হতেন-
قَام اِلَيْهَا فَاَخَذَ بِيَدِهَا فَقَبَّلَها وَاَجْلَسَهَا فِىْ مَجْلِسِه
তখন তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন, হাত ধরে হাত চুমু খেতেন এবং নিজের জায়গায় তাঁকে বসাতেন। অনুরূপ হুযুর আলাইহিস সালাম যখন হযরত ফাতিমা যুহরা (রা:) এর কাছে তশরীফ নিয়ে যেতেন, তখন তিনি (ফাতিমা) ও দাঁড়িয়ে যেতেন, দস্ত মুবারকে চুমু খেতেন এবং স্বীয় জায়গায় হুযুর আলাইহিস সালামকে বসাতেন। মিরকাতالمشئ بالجنازة অধায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আছে-
وَفِيْهِ اِيْمَاءٌ اِلَى نُدُبِ الْقِيَامِ لِتَعْظِيْمِ الْفُضَلَاءِ وَالْكُبَرَاءِ
জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সম্মানে দাঁড়ানো জায়েয।
চতুর্থত: যখন কোন প্রিয়জনের কথা শুনে বা অন্য কোন শুভ সংবাদ পায়, তখন সে সময় দাঁড়িয়ে যাওয়া মুস্তাহাব এবং সাহাবা ও পূর্ববর্তীগণের সুন্নাত। মিশকাত শরীফের কিতাবুল ঈমানের তৃতীয় পরিচ্ছেদে হযরত উছমান (রা:) থেকে বর্ণিত আছে, আমাকে হযরত সিদ্দিক আকবর (রা:) যখন একটি শুভ সংবাদ শোনলেন-
فَقمْتُ اِلَيْهِ وَقُلْتُ بِاَبِىْ اَنْتَ وَاُمِّىْ اَنْتَ اَحَق بِهَا
তখন আমি দাঁড়িয়ে গেলাম এবং বললাম আপনার প্রতি আমার মা-বাপ কুরবান, আপনিই এর উপযোগী।
তাফসীরে রুহুল বয়ানে ২২ পারায় সূরা ফাতহের আয়াত محمد رسول الله এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে যে, ইমাম তকিউদ্দিন সুবকী (র:) এর দরবারে উলামায়ে কিরামের একটি দল উপস্থিত ছিলেন। একজন না’ত আবৃত্তিকারী দুটি না’ত পাঠ করলেন-
فَعِنْدَ ذَالِكَ قَامَ الْاِمَامُ السُّبْكِىُّ وَجَمِيْعُ مَنْ فِىْ الْمَجْلِسِ فَحصَلَ اَنْس عَظِيْمٌ بِذَالِكَ الْمَجْلِسِ
তখন সাথে সাথে ঈমাম সুবকী ও মজলিসে আগত সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাতে বেশ আনন্দ পাওয়া গেল।
পঞ্চমত: কোন কাফির যিনি স্বীয় সম্প্রদায়ের নেতা, যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রতি আগ্রান্বিত হন, তাহলে তাঁর আগমনে তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়ানো সুন্নাত । যেমন হযরত উমর (রা:) যখন ইসলাম গ্রহন করার জন্য হুযুরের খিদমতে হাযির হলেন, তখন হুযুর আলাইহিস সালাম তাঁকে নিজের পবিত্র বুকের সাথে লাগালেন (ইতিহাস গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) ।
ফতওয়ায়ে আলমগীরীর কিতাবুল কারাহিয়া শীর্ষক اهل الذمة অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-
اِذَدَخَلَ ذِمِّى عَلى مُسْلِمِ فَقَامَ لَه طمعًا فِىْ اِسْلَامِه فَلَا بَأَسَ
কোন যিম্মি কাফির মুসলমানের কাছে আসলো, মুসলমান তার ইসলাম গ্রহণের আশায় তার সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন, এটা জায়েয।
(৫) কয়েক জায়গায় দাঁড়ানো মাকরূহ :-
প্রথমত: যমযম ও ওযুর পানি ব্যাতীত অন্যান্য পানি পান করার সময় বিনা কারণে দাঁড়ানো মাকরূহ,
দ্বিতীয়ত : পার্থিব লালসায় বিনা কারণে দুনিয়াবী লোকের সম্মানে দাঁড়ানো মাকরূহ।
তৃতীয়ত: ধন-দৌলতের কারণে কাফিরের সম্মানার্থে দাঁড়ানো মাকরূহ।
ফতওয়ায়ে আলমগীরীর কিতাবুল কারাহিয়া শীর্ষক اهل الذمة অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
وَاِنْ قَامَ لَهُ مِنْ غَيْرِ اَنْ يَّنْوِىَ شَيْئًا مِمَّا ذَكَرْنا اوْ قَامَ طَمْعًا لِغِنَاهُ كُرِهَ لَهَ ذَالِكَ
যদি কারো জন্য উল্লেখিত অবস্থাদি ব্যতিত দাঁড়ানো হয় বা সম্পদের লালসায় দাঁড়ানো হয়, তাহলে তা মাকরূহ হবে।
চতুর্থত: যে ব্যক্তি নিজের তাযীমের জন্য লালায়িত, তার সম্মানার্থে দাঁড়ানো নিষেধ।
পঞ্চমত: যদি কোন বড় লোক মাঝখানে বসা অবস্থায় আছে এবং তার চারদিকে বিনীতভাবে মানুষ দাঁড়িয়ে রইল। এ ধরনের দাঁড়ানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিজের জন্য কারো দাঁড়িয়ে থাকা পছন্দ করাটাও নিষেধ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে এর প্রমাণ দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ । এ প্রকারভেদটা যেন স্মরণ থাকে।
উপরোক্ত বিশ্লেষন থেকে এটা নি:সন্দেহে জানা গেল যে মীলাদ শরীফে পবিত্র বেলাদতের আলোচনা করার সময় কিয়াম করাটা সাহাবায়ে কিরাম ও পূর্ববর্তী নেককার বান্দাদের থেকে প্রমাণিত রয়েছে। আমি সুন্নাত কিয়ামের বর্ণনায় চতুর্থ পর্যায়ে সে ধরণের কিয়ামের কথা উল্লেখ করেছি, যা কোন খুশির সংবাদ পেয়ে বা কোন প্রিয়জনের আলোচনার সময় করা হয় এবং প্রথম পর্যায়ে ওই ধরনের কিয়ামের কথা উল্লেখ করেছি, যা ধর্মীয় মর্যাদাশীল কোন জিনিসের সম্মানে করা হয়। সুতরাং, মীলাদ শরীফে কিয়াম কয়েক কারণে সুন্নাত। প্রথমত: এটা পবিত্র বেলাদাতের আলোচনার সম্মানে করা হয়। দ্বিতীয়তঃ এ জন্য যে, মুসলমানদের জন্য যিকরে বিলাদতের চেয়ে বড় খুশির বিষয় আর কি হতে পারে আর খুশির সংবাদে দাঁড়ানো সুন্নাত। তৃতীয়ত: মুসলমানের কাছে নবী করীম (দ:) থেকে বেশী প্রিয় আর কে আছে? মা-বাপ,ধন-সম্পদ ইত্যাদি সব কিছু থেকে বেশি প্রিয়ভাজন হচ্ছেন হুযুর আলাইহিস সালাম । তাঁর যিকরের সময় দাঁড়ানো পূর্বসূরী নেকবান্দাদের সুন্নাত।
চতুর্থত: পবিত্র বেলাদতের সময় ফিরিশতাগণ দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এজন্য পবিত্র বেলাদতের আলোচনার সময় দাঁড়ানো ফিরিশতাদের কাজের সাথে মিল রয়েছে।
পঞ্চমত: আমি মীলাদ শরীফের আলোচনায় হাদীছ দ্বারা প্রমান করেছি যে, হুযুর আলাইহিস সালাম স্বীয় গুনাবলী ও বংশ পরিচয় মিম্বরে দাঁড়িয়ে বর্ণনা করেছেন। এতে কিয়ামের মুল বৈশিষ্ট পাওয়া যায়।
যষ্ঠত: শরীয়ত একে নিষেধ করেনি এবং প্রত্যেক দেশে সাধারণ মুসলমানগণ একে ছওয়াবের কাজ মনে করে পালন করে। যে কাজটা মুসলমানগণ ভাল মনে করে, সে কাজ আল্লাহর কাছেও ভাল বলে গণ্য। আমি এর বিশ্লেষণ মীলাদ ও বিদআতের আলোচনায় করেছি। অধিকন্তু প্রথমেই আরয করেছি যে মুসলমান যে কাজটাকে মুস্তাহাব হিসেবে জানে, শরীয়তেও তা মুস্তাহাব হিসেবে গণ্য। ফতওয়ায়ে শামীর তৃতীয় খন্ড কিতাবুল ওয়াকফের وقف منقولات শীর্ষক আলোচনায় বর্ণিত আছে-
لِاَنَّ التُّعَامَلَ يُتْرَكُ بِه الْقِيَاسُ لِحَدِيْثِ مَارَأَه الْمُؤْمِنُوْنَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَن
ডেকসি, জানাযার খাটিয়া ইত্যাদির ওয়াকফ ধারণামত নাজায়েয হওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু সাধারণ মুসলমানগণ এর অনুসারী, সেহেতু কিয়াসকে বাদ দেয়া হয়েছে এবং ওটাকে জায়েয বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। দেখুন, সাধারণ মুসলমানগণ যে কাজটা ভাল মনে করে এবং এর হারাম হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট দলীল না থাকে, তখন কিয়াসকে বাদ দেয়া প্রয়োজন।
দুররূল মুখতারের পঞ্চম খন্ড কিতাবুল ইজারাতের اجارة الفاسده অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-
স্নানাগার ভাড়া দেয়া জায়েয, কেননা হুযুর আলাইহিস সালাম হাজফা শহরের স্নানাগারে তশরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন এবং এজন্য এটা প্রচলন হয়ে গেছে। হুযুর আলাইহিস সালাম ফরমান, যেটা মুসলমানগণ ভাল মনে করেন, সেটা আল্লাহর কাছেও ভাল।
এর প্রেক্ষাপটে ফতওয়ায়ে শামীতে উল্লেখিত আছে যে হুযুর আলাইহিস সালামের হাজফা শহরের স্নানাগারে প্রবেশ করার বর্ণনাটি খুবই দুর্বল। কেউ কেউ একে মওজু বা বানাওট হাদীছ বলেছেন। সুতরাং, স্নানাগার জায়েয হওয়ার একটি মাত্র দলীল অবশিষ্ট রইল অর্থাৎ সাধারণভাবে প্রচলনটাতো প্রমাণিত হলো। মুসলমানগণ যে কাজটা সাধারণভাবে বৈধ মনে করে, তা জায়েয। একই জায়গায় শামীতে আরও উল্লেখ আছে-
لِاَنَّ النَّاسَ فِىْ سَائِرِ الْاَمْصَارِ يَدْفَعُوْنَ اُجْرَةَ الْحَمَّامِ فَدَلَّ اِجْمَاعُهُمْ عَلى جَوازِ ذَالِكَ وَاِنْ كَانَ الْقِيَاسُ يَابَاهُ
কেননা সব শহরগুলোতে মুসলমানগণ স্নানাগারের ফি দিয়ে থাকেন। সুতরাং তাদের ঐক্যমতের কারণে জায়েয হওয়াটা বোঝা গেল, যদিওবা এটা কিয়াসের বিপরীত। কিয়াস অনুসারে স্নানাগারের ফি নাজায়েয হওয়াটাই বাঞ্চনীয়। কেননা কতটুকু পানি ব্যবহার হবে তা জানা যায় না। অথচ ভাড়ার ব্যাপারে লাভ ক্ষতি সম্পর্কে জানাটা প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু মুসলমানগণ সাধারণভাবে একে জায়েয মনে করে, সেহেতু এটা জায়েয। মীলাদ শরীফে কিয়াম করাটা সর্বসাধারণ মুসলমানগণ মুস্তাহাব মনে করেন। সুতরাং এটা মুস্তাহাব।
সপ্তমত: এ জন্য যে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান – وَتُعَزِّرُوْاهُ وَتَوقِّرُوْاهُ “(হে মুসলমানগণ আমার নবীকে সাহায্য কর ও তাঁকে সম্মান কর)”
তাযীমের বেলায় কোন বাঁধা ধরা নিয়ম নেই, বরং যে যুগে বা যে জায়গায় তাযীমের যে রীতি প্রচলিত, সেভাবে তাযীম করুন, যদি শরীয়ত একে হারাম না করে থাকে। যেমন তাযীমী সিজদা ও রুকু করা হারাম । আমাদের যুগে রাজকীয় হুকুমাদিও দাঁড়িয়ে পাঠ করা হয়। সুতরাং হুযুর আলাইহিস সালামের যিকরও দাঁড়িয়ে করা চাই। দেখুন- كُلُوْا وَاشْرَبُوْا (খান ও পান করুন) বাক্যে শর্তহীনভাবে খানা পিনার অনুমতি রয়েছে অর্থাৎ প্রত্যেক হালাল আহার্য গ্রহন করুন। তাই বিরানী, জরদা, কোরমা ইত্যাদি সবই কুরূনে ছালাছায় থাকুক বা না থাকুক হালাল। এ রকম توقرواه শব্দেও শর্তহীন নির্দেশ রয়েছে যে প্রত্যেক প্রকারের বৈধ তাযীম করুন কুরূনে ছালাছা থেকে এটা প্রমাণিত হোক বা না হোক।
অষ্টমত: আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান-
وَمَنْ يُعَظِّمُ شَعَائِرَ اللهِ فَاِنهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ
“যে ব্যক্তি আল্লাহর নিশানা সমূহের সম্মান করে, তা হবে আত্মার সংযমশীলতার বহি:প্রকাশ”
তাফসীরে রূহুল বয়ানে আয়াত-
وَتَعَاوَنُوْا عَلَى البِّرِّ وَالتَّقْوى وَلَا تَعَاوَنُوْا عَلَى الْاِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
এর ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে যে, যে জিনিসটা ধর্মীয় মর্যাদা লাভ করেছে, তা আল্লাহর নিশানা সমূহের অন্তর্ভূক্ত, সে সবের সম্মান করা প্রয়োজন। যেমন, বিশেষ মাস, কোন বিশেষ দিন বা স্থান সমূহ, কোন বিশেষ নিদৃষ্ট সময় ইত্যাদি। এ জন্যই সাফা-মারওয়া, কাবা মুয়াজ্জমা, মাহে রমজান, শবে কদরের তাযীম করা হয়। যিকরে বিলাদতও আল্লাহর নিশানাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। অতএব এর তাযীমও করনীয়, যা কিয়ামের মাধ্যমে আদায় হয়।
আমি আটটি দলিলের সাহায্যে কিয়াম মুস্তাহাব হওয়াটা প্রমাণ করলাম। কিন্তু বিরোধিতাকারীদের কাছে খোদার রহমতে হারাম প্রমাণ করার একটি ধলীলও নেই। কেবল স্বীয় মনগড়া অভিমত দ্বারাই হারাম বলেন।
-সুত্রঃ জা’আল হক ২য় খন্ড-